বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে দুর্ভোগে ঢাকাবাসী
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক রাজধানীতে পরিণত হচ্ছে ঢাকা। তবে এ শহরের পেছনে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ সত্ত্বেও এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে এখনও পুরোপুরি সামলে উঠে পারেনি কার্তৃপক্ষ।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন গত ৭ বছরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করেছে ৩,৩২৩ কোটি টাকা। তবুও শহরজুড়ে প্রায় ২৫০টি অনিয়ন্ত্রিত খোলা আবর্জনার ভাগাড় রয়েছে, যা মারাত্মক দূষণ ঝুঁকি তৈরির পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের ওপরেও ফেলছে বিরূপ প্রভাব।
এছাড়া, সিটি কর্পোরেশনের সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) গুলোও প্রায়শই দেখা যায় অপরিকল্পিত জায়গা যেমন- হাসপাতাল, পার্ক, স্কুল কিংবা ব্যস্ত রাস্তার আশেপাশে অবস্থিত।
এই স্টেশনগুলোর আশেপাশে বসবাস বা চলাচলকারী মানুষদের জন্য এটি নিত্য দিনের ভোগান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাদিন বর্জ্য জমে থাকার কারণে পুরো এলাকাজুড়ে ছড়াতে থাকে দুর্গন্ধ। এছাড়া, রাস্তায় আবর্জনা সংগ্রহের ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকার কারণে প্রায়শই এলাকাগুলোতে যানজট লেগে যায়। যানবাহনে থাকা যাত্রীদের বাধ্য হয়েই বসে থাকতে হয় দুর্গন্ধের মধ্যে।
এরকমই একটি স্টেশন রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কলাবাগান মাঠের পাশে। তবে এর ভেতরে যতটা না বর্জ্য রাখা হয়, তার থেকে এর সামনের রাস্তায় বর্জ্যের ভ্যানে রাখা থাকে বেশি।
দুপুরের পর থেকেই এসটিএসের সামনে রাখা শুরু হয় বর্জ্যের ভ্যান। যা মধ্যরাত পর্যন্ত সেখানে রাস্তার বড় একটি অংশ দখল করে রাখে।
এখানে শুধু রাস্তা দখল করে রাখাই নয়, বর্জ্যের জলীয় অংশ রাস্তায় জমতে থাকে এবং এর দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে আশপাশে।
রাতে যখন সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য পরিবহনের বড় ট্রাক আসে, তখন এ বর্জ্য ঢেলে ট্রাকে নেওয়া হয়।
এ রাস্তা দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী শিমুল মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই এলাকায় বর্জ্যের ভ্যানের কারণে যানজট লেগে থাকে। তবে এখানে যানজটের থেকেও অসহ্যকর হচ্ছে বর্জ্যের দুর্গন্ধ। সন্ধ্যায় এ রাস্তা দিয়ে চলাচলের মতো পরিবেশ থাকে না। দম বন্ধ করে এ অংশ পারাপার হতে হয়।"
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) অ্যাডভাইসর প্রফেসর আক্তার মাহমুদ টিবিসকে বলেন, "আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপেই পরিবর্তন আনা দরকার। বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথকীকরণ এবং ল্যান্ডফিলে সংরক্ষণ- এ তিনটি ধাপেই ঝামেলা আছে।
"বর্জ্য যারা সংগ্রহ করছেন তারা সঠিক পদ্ধতিতে করছে কিনা, এসটিএসে পৃথকীকরণে নিয়জিত কর্মীরা পোশাক সঠিকভাবে পরিধান করছেন কিনা এবং বর্জ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে কিনা- এ বিষয়গুলোতে মনিটরিং হচ্ছে না। দুই সিটি কর্পোরেশনের কোনোটিই এসব ক্ষেত্রে প্রটোকল মানছে না," যোগ করেন তিনি।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
সিটি কর্পোরেশনের তথ্যমতে, দুই সিটির ১২৯টি ওয়ার্ডে প্রতিদিন প্রায় ৬৮০০ মে. টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার অধিকাংশই দুই সিটি কর্পোরেশনের ল্যান্ডফিলে পাঠানো হয়। তবে সিটি কর্পোরেশনের হিসাব মতে, ৩০ টি ওয়ার্ডেই কোনো এসটিএস নেই।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্জ্য সংগ্রহকারীরা ভ্যান ব্যবহার করে সরাসরি বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবর্জনা সংগ্রহ করেন। পরে সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ট্রাকগুলো এই আবর্জনা ল্যান্ডফিলে নিয়ে যায়।
তবে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহের এই ব্যবস্থাটি কমিউনিটি দ্বারা চালু হয়েছে। বর্জ্য সংগ্রহকারীরা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক অনুমোদিত হলেও তারা কর্পোরেশনের কর্মী নন। বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণও নেই।
সিটি কর্পোরেশনের তথ্যমতে, এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুই সিটিতে ৪৭৩টি বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও গাড়ি ব্যবহৃত হয়। সেইসঙ্গে প্রায় ১০ হাজার কর্মী এ ব্যবস্থাপনায় কাজ করছেন।
ঢাকা দক্ষিণের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী শহরের অগোছালো বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আবর্জনা সংগ্রহকারীদের দায়ী করে বলেন, "তারা (সংগ্রাহকরা) সঠিকভাবে নিয়ম মানছেন না।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, "আমরা বদ্ধ গাড়িতে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করার বিষয়ে ভাবছি। এছাড়া কঠিন ও ভেজা বর্জ্য আলাদা আলাদা সংগ্রহ করতে একটি ওয়ার্ডে পাইলটিং করার পরিকল্পনাও রয়েছে।"
এদিকে মিরপুরের বর্জ্য সংগ্রহকারী ইউনুস খান জানান, তাদের প্রশিক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।
তিনি বলেন, "আমাদের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। মাঝে মাঝে সিটি কর্পোরেশন প্রোগ্রাম পরিচালনা করে, কিন্তু আমাদের সেগুলোতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় না। এই প্রোগ্রামগুলো শুধু সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারীদের জন্য। আমরা ন্যূনতম বেতন পাই; নিরাপত্তার বিষয়েও আমাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই।"
ঢাকা উত্তর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শফিকুর রহমান বলেন, "আমরা বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছি এবং এরমধ্যে এখন যতটুকু বিশৃঙ্খলা আছে, তা সম্পূর্ণরূপে শৃঙ্খলায় চলে আসবে।"
"চীনের কোম্পানির সঙ্গে আমাদের এমনটাই চুক্তি হয়েছে যে, আমরা তাদেরকে মিক্সড বর্জ্য দেবো। সুতরাং বর্জ্য আলাদা করার কোনো দরকার হবে না," যোগ করেন তিনি।
বর্জ্য অব্যবস্থাপনার ঝুঁকি
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতে ঢাকাতেই মারা যায় ১৮ হাজার মানুষ।
কঠিন এবং তরল বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ৪ মিলিয়ন শিশুসহ বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৫.২ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।
২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত 'বাংলাদেশে আরবান ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট: অ্যান ওভারভিউ উইথ আ ফোকাস অন ঢাকা' শীর্ষক ওই গবেষণায় গত তিন দশকের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে বলা হয়, শহরাঞ্চলে গড়ে ৫৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্য সংগ্রহই করা হয়না।