চট্টগ্রাম বন্দরে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে কন্টেইনার টার্মিনাল করতে চায় মার্স্ক লাইন
প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়ার চর এলাকার ৫৩ একর জায়গায় কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায় ডেনমার্ক-ভিত্তিক গ্লোবাল শিপিং জায়ান্ট মার্স্ক লাইন।
বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে মার্স্ক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রবার্ট মার্স্ক উগ্লা এবং বাংলাদেশে ডেনিশ চার্জস ডি'অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড্রেস বি কার্লসেন সোমবার (২৮ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেছেন।
প্রস্তাব শুনে প্রধানমন্ত্রী তাদের বলেছেন, নতুন কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার প্রস্তাবটি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে।
মার্স্ক গ্রুপের প্রতিনিধি ও ডেনিশ চার্জ ডি'অ্যাফেয়ার্স নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং বন্দর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্টেকহোল্ডার সংস্থার সাথেও বিনিয়োগ প্রস্তাবের বিষয়ে বৈঠক করেছেন।
বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুযায়ী, লালদিয়ার চরের ৫৩ একর জায়গায় টার্মিনাল তৈরিতে শতভাগ বিনিয়োগ করবে মার্স্ক গ্রুপ। টার্মিনাল পরিচলানায় ৯৫ শতাংশের বেশি লোকবল কাজ করবে বাংলাদেশি। এখানে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে মার্স্ক লাইনের এই নতুন বিনিয়োগ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বন্দরসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরে যত বিদেশি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান যুক্ত হবে, বন্দরের সেবার মান তত উন্নত হবে। বিশেষ করে ডলার সংকটের এই সময়ে নতুন বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যেকোনো বিদেশি বিনিয়োগ দেশের জন্য উপকারী। চট্টগ্রাম বন্দরে মার্স্ক লাইনের বিনিয়োগকে তিনি স্বাগত জানান।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ বিনিয়োগের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহন সম্প্রসারিত হবে। তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের রপ্তাানি বাড়বে। বাড়বে আমদানির পরিমাণও। এর ফলে জাহাজ বার্থিংয়ের সময় কমে আসবে; লিড টাইম কমে আসবে। কমবে পণ্য পরিবহন ব্যয়। গতিশীল হবে ব্যবসা-বাণিজ্য।
চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ওমর হাজ্জাজ বলেন, মার্স্ক লাইনের মতো প্রতিষ্ঠান বন্দর সুবিধা বাড়াতে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসা, দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে।
"এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে আরও নতুন বিনিয়োগ আসার পথ তৈরি হবে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে মার্স্ক লাইনের নতুন বিনিয়োগ প্রস্তাবকে আমরা সাধুবাদ জানাই," যোগ করেন তিনি।
বিকেএমইএ'র ডিরেক্টর মোহাম্মদ শামসুল আজম বলেন, বন্দর পরিচালনায় কোনো গ্লোবাল জায়ান্ট যুক্ত হওয়ার অর্থ হলো অপারেশনাল কার্যক্রমে গতিশীলতা আসা।
"বর্তমানে আমদানি পণ্য ডেলিভারি, রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে আমরা নানামুখী সমস্যায় পড়ি। এতে লিড টাইম বেড়ে যায়। নতুন টার্মিনাল হলে সেটি কমে আসবে। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য সেটি মঙ্গলজনক," বলেন তিনি।
এদিকে, কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাধীন পতেঙ্গার লালদিয়ার চর এলাকাটি ছিল অবৈধ দখলে। ২০২১ সালের মার্চে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দখল মুক্ত করে বন্দর। দুই বছরের অধিক সময় খালি পড়ে আছে ওই এলাকা। লালদিয়ার চরের ৫৩ একর জায়গায় টার্মিনাল গড়ে তোলা যেতে পারে বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, "লালদিয়ার চরে বন্দর কর্তৃপক্ষের ৫৩ একর জায়গা রয়েছে। সেখানে একটি টার্মিনাল করার জন্য বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে মার্স্ক লাইন। দেশের স্বার্থ রক্ষা করে বিদেশি বিনিয়োগ আসলে সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই।"
বাংলাদেশে কন্টেইনার যোগে পরিবাহিত পণ্যের ৯৮ শতাংশ পরিবহন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। রপ্তানি পণ্য জাহাজে তোলার আগে স্টাফিং (কন্টেইনার ভর্তি) করা হয় চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি আইসিডিতে। এসব আইসিডি থেকে জাহাজযোগে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৩০ শতাংশ পণ্য মার্স্ক লাইন শিপিং কোম্পানি পরিবহন করে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ কন্টেইনার পরিবহন হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবাহিত আমদানি-রপ্তানি কন্টেইনারের এক-তৃতীয়াংশ মার্স্ক লাইন পরিবহন করে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এদিকে গত ২২ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেছিলেন, "চট্টগ্রাম বন্দরে সাথে ডেনমার্কের অর্থায়নে লালদিয়ায় টার্মিনাল নির্মিত হবে। এশিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রাম বন্দরে বিনিয়োগে আগ্রহী। আগামী ৩ বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঁচ থেকে সাত বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসবে।"
মার্স্ক লাইনের ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এ পি মোলার-মার্স্ক বিশ্বের ৬৫টি দেশে কন্টেনইনার টার্মিনাল পরিচালনা করছে।
বন্দর ব্যবহারকারী সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মেরিটাইম সেক্টরে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে মার্স্ক লাইন। বিভিন্ন আইসিডিতে যৌথ বিনিয়োগে গড়ে তুলছে ওয়্যার হাউস। এসব ওয়্যার হাউসে নিজেদের শিপিং কোম্পানির পরিবাহিত পণ্য স্টাফিং করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে মার্স্ক লাইন চট্টগ্রামের ইসপাহানি সামিট অ্যালায়েন্স টার্মিনাল লিমিটেড (আইএসএটিএল) এবং ভার্টেক্স অফ-ডক লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেডে তিন লাখ স্কয়ার ফিটের দুটি ওয়্যার হাউস নির্মাণ করেছে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল)-এ আরও ২ লাখ ১০ হাজার স্কয়ার ফিটের ওয়্যার হাউস চালু হবে। এটি চালু হলে চট্টগ্রামে তিনটি ডিপোতে মার্স্ক লাইনের ৫ লাখ স্কয়ার ফিটের ওয়্যার হাউস সুবিধা তৈরি হবে।