অর্থ ব্যবহারে উন্নতি দেখছে এডিবি, সঙ্গে চ্যালেঞ্জও
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চুক্তি না হওয়া ও ছাড় না করা অর্থের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এই হিসাব বলছে, বিভিন্ন প্রকল্পে এসব অর্থ ব্যবহারে অগ্রগতির হচ্ছে।
তবে এডিবি বাংলাদেশকে চুক্তি সম্পন্ন ও অর্থ ছাড়ে উন্নতি করার জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিয়েছে। এতে বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে ব্যাংকটি থেকে অর্থ পাওয়া আরও সহজ হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে এডিবি থেকে বাংলাদেশের পাওয়া অর্থের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ২০১৩ বাংলাদেশের পোর্টফোলিও ছিল ৫.৩ বিলিয়ন ডলার—২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট নাগাদ তা বেড়ে ১৩.০১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের পোর্টফোলিওর পরিমাণ বছরে ৯.৩৯ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। প্রতি বছরই বাংলাদেশকে এডিবির দেওয়া ঋণ বাড়তে থাকায় এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য একটি বৈঠকে সংস্থাটির প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করার সময় এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত শতাংশের হিসাবে এডিবির মোট ঋণ-পোর্টফোলিওর চুক্তি না হওয়া অংশ হচ্ছে ২০.৭ শতাংশ বা ২.৬৯ বিলিয়ন ডলার—যা এক বছর আগের ৩২ শতাংশ বা ৩.১৪ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে কম। এছাড়াও ছাড় না করা অর্থের পরিমাণও আগের বছরের ৪৫ শতাংশ থেকে কমে ৪০.৭ শতাংশ বা ৫.২৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে বলে উল্লেখ করেছে এডিবি।
বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটি বলেছে, এডিবির দেওয়া মোট ঋণের অর্ধেকেরও বেশি যেহেতু পরিবহন ও জ্বালানি খাতেই যায়, তাই চুক্তি ও ছাড় না অর্থে এ দুই খাতের হিস্যা অন্যান্য খাতের চেয়ে বেশি।
চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত মোট চুক্তি না হওয়া ঋণে কৃষি, খাদ্য, প্রকৃতি ও পল্লি উন্নয়ন এবং পরিবহন খাতের হিস্যা ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে মোট ছাড় না হওয়া ঋণে পরিবহন ও জ্বালানি খাতের হিস্যা ৪৬ শতাংশ।
এডিবি বলছে, কৃষি, খাদ্য, প্রকৃতি ও পল্লি উন্নয়ন খাতে ২০২৩ সালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে নতুন প্রতিশ্রুতি দেওয়া ৪২০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ রয়েছে। পরিবহন খাতে ২০২৩ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি নতুন প্রতিশ্রুতি দেওয়া ঋণ রয়েছে।
২০২৩ সালে জ্বালানি খাতের জন্য কোনো ঋণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। তারপরও প্রকল্পগুলোর বিলম্বিত ক্রয় ও কাজের ধীরগতির কারণে এ খাতে চুক্তি না হওয়া ও ছাড় না করা ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ১৮ শতাংশ ও ২১ শতাংশ। পানি জল ও নগর উন্নয়ন খাতে চুক্তি ও ছাড় না হওয়া ঋণের পোর্টফোলিও যথাক্রমে ১৯ শতাংশ ও ১৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে এ খাতে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতির কারণে এমনটি হয়েছে বলে জানিয়েছে এডিবি।
দেশে এডিবির অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো মূল্যায়ন করতে গিয়ে বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটি বলেছে: কৃষি, খাদ্য, প্রকৃতি ও পল্লি উন্নয়ন, পরিবহন, পানি ও নগর উন্নয়ন খাতে চুক্তি সম্পন্ন এবং জ্বালানি ও পরিবহন খাতে অর্থ ছাড়ে উন্নতি করার জন্য আন্তরিক ও সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এছাড়া এসব খাতের কাজের মান আরও উন্নত করার জন্য প্রকল্পকেন্দ্রিক সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছে এডিবি।
বাংলাদেশে এডিবির চলমান পোর্টফোলিও
চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে এডিবির পোর্টফোলিওর পরিমাণ ছয়টি খাতে ৫৩টি প্রকল্পের জন্য ১৩.০১ বিলিয়ন ডলার। কৃষি, খাদ্য, প্রকৃতি ও পল্লি উন্নয়নে সাতটি প্রকল্প, মানব ও সামাজিক উন্নয়নে ১১টি প্রকল্প, জ্বালানিতে সাতটি, পরিবহনে ১২টি, পানি ও নগর উন্নয়নে ১০টি এবং অর্থ ও সরকারি খাতে ব্যবস্থাপনা ও শাসনে ছয়টি প্রকল্প রয়েছে। মোট পোর্টফোলিওতে পরিবহন এবং মানব ও সামাজিক উন্নয়ন খাতের হিস্যা ৪৫.৭ শতাংশ।
২০২৩ সালের পোর্টফোলিওর পারফরম্যান্স
২০২২ সাল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চুক্তি সম্পন্ন ও অর্থ ছাড়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ২০২৩ সালের জন্য বার্ষিক ১,০৭৬ মিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চুক্তি অনুমোদন হয়েছে ৭৯৩.১৮ মিলিয়ন ডলার (৭৩.৭ শতাংশ)। আর ১,৪১৪.১ মিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ছাড় হয়েছে ৯৪০.৪৪ মিলিয়ন ডলার (৬৬.৫ শতাংশ)। ২০২২ সালে এ দুই ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনের হার ছিল যথাক্রমে ৫২ শতাংশ ও ৫৮ শতাংশ। এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
প্রকল্পের সাফল্যের হার
সামগ্রিকভাবে, গত পাঁচ বছরে প্রকল্পের সাফল্যের হার হলো ৬৮ শতাংশ—যা ৬৮ শতাংশ আঞ্চলিক সাফল্যের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও, এডিবির কর্পোরেট লক্ষ্যমাত্রা ৮০ শতাংশের চেয়ে কম। তবে তিন বছরের প্রকল্পের গড় সাফল্যের হিসাব করলে দেখা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি হয়েছে। ২০২০ সালে প্রকল্পের সাফল্যের হার ছিল ৫১ শতাংশ, ২০২১ সালে তা বেড়ে ৭৫ শতাংশ ও ২০২২ সালে ৭৭ শতাংশ হয়েছে। ২০২৩ সালে মূল্যায়নাধীন পাঁচটি প্রকল্পই সফল রেটিং পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা পারফরম্যান্স রেটিং
বাংলাদেশে এডিবির সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর জন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্প পারফরম্যান্স রেটিং সন্তোষজনক। ৪১টি (৯১ শতাংশ) প্রকল্পকে 'অন ট্র্যাক' এবং ৪টি (৯ শতাংশ) প্রকল্পকে 'ফর অ্যাটেনশন' রেটিং দেওয়া হয়েছে।
ক্রয়ের লিড টাইম
১ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি ব্যয়ের প্রকল্পগুলোতে পুরো ক্রয়-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যে সময় লাগে, তা বেড়ে ৩১১ দিনে দাঁড়িয়েছে—যা ২০২২ সালের ২১৪ দিনের চেয়ে অনেক বেশি। পরিবহন, জ্বালানি, এবং জল ও নগর উন্নয়ন খাতে পুরো ক্রয়-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে লম্বা সময় লেগেছে। বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোতে গড়ে ৪১০ দিন সময় লেগেছে।
বিড মূল্যায়নে বিলম্ব, ডিপিপি সংশোধন ও চুক্তি সম্পন্ন করার আগে ঠিকাদারদের প্রিপেইড মিটারের ইন্টারঅপারেবিলিটি দেখাতে হয় বলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রায় ৬০০ দিন সময় লেগেছে।
ক্রয়ের চ্যালেঞ্জ
বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে ক্রয়-প্রক্রিয়া এবং পরামর্শক নিয়োগ বিলম্বিত হয়েছে। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ নকশা ও স্পেসিফিকেশন, সেকেলে প্রাক্কলন, অস্পষ্ট বিড ডকুমেন্ট, দক্ষতার অভাবে বাজে বিড, বিড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মূল্যায়ন না করা, সরকারের অনুমোদন পেতে বিলম্ব হওয়া এবং যথাযথ বাজার মূল্যায়ন করতে না পারা।
২০২৩ সালে ক্রয়-প্রক্রিয়া ১০ শতাংশ সহজতর করতে চায় এডিবি। এজন্য তারা ১ মিলিয়ন ডলারের বেশি প্যাকেজের প্রক্রিয়াগুলো তত্ত্বাবধান করতে ডেডিকেটেড ক্রয়-কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে। এই কৌশলগত পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে এসব সমস্যার সমাধান করা, দক্ষতা বাড়ানো এবং ক্রয়-ব্যর্থতা ও দ্বিতীয় দফা বিডের ঝুঁকি কমানো।