১৩৪ মি.মি. বৃষ্টিতেই রাজধানীতে মৃত্যু, জলাবদ্ধতা, পানিবন্দি মানুষ
বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) ভারী বর্ষণে নগরীর বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ার পর শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাত পর্যন্ত রাজধানীর বেশকিছু এলাকা থেকে পানি নামেনি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ঢাকায় প্রায় ১৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
ভারী বর্ষণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন নিউমার্কেট, বংশাল, জুরাইন, মাতুয়াইল, মিরপুর-২, দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, আশকোনাসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা।
জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রধান দায়িত্বে থাকা ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন বলছে, তারা জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে এবং এখনও যেসব জায়গায় জলাবদ্ধতা রয়েছে সেসব স্থানের পানি নিষ্কাশনে কাজ করছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা। তাদের দাবি, অলিগলির ড্রেনেজ ব্যবস্থা কিছু এলাকায় উন্নত না হওয়ায় এবং ড্রেনের মুখে প্লাস্টিক আটকে জলাবদ্ধতা দীর্ঘক্ষণ রয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকার জলাবদ্ধতার জন্য সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, রাজউক, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সকল সংস্থার দায় আছে। জলাধার ভরাট করা, খাল দখল করা, লোকাল ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন না করার কারণে দিন দিন জলাবদ্ধতা বাড়ছে। তবে কিছু উদ্যোগ নিয়ে জলাবদ্ধতা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও এ নগরীকে একেবারে জলাবদ্ধতামুক্ত করা সম্ভব নয় বলে তাদের অভিমত।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, "বিগত কয়েক বছরে আমাদের জলাধারগুলো অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। পুকুরগুলো ভরাট হয়ে গেছে। আমাদের খাল, লেক, ড্রেনের সাথে সরল কোনো লিংক নেই। বিশেষ করে লোকাল ড্রেনগুলো সরু এবং অধিকাংশ বর্জ্যে ভরাট হয়ে থাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়।"
"এজন্য শক্ত হাতে পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকার বক্স কালভার্টগুলো ভেঙ্গে খালের গতিপথ ঠিক করে এবং খাল ও ড্রেনগুলো প্রতিবছর পরিষ্কার করে পানির গতিপথ ঠিক করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
এ নগর পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, "যদি পরিকল্পনা নিয়ে ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করে গতিপথ ঠিকও করা হয়, তাহলেও ঢাকার জলাবদ্ধতা ২৫ শতাংশের বেশি কমানো সম্ভব নয়। কারণ আমাদের নগরই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এক্ষত্রে নগরবাসীরও দায় আছে, তারা বর্জ্য ফেলে ড্রেন-খাল ভরাট করেছে, বাড়ি নির্মাণের সময় ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও রাস্তার জন্য জায়গা কম রেখেছে। সব মিলেই নগরবাসী ভুগছে।"
বৃহস্পতিবারের বৃষ্টির পরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এলাকাধীন জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০টি কুইক রেসপন্স টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছে উত্তর সিটি। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়ে কাজের কোনো তথ্য দিতে পারেননি দক্ষিণের কর্মকর্তারা।
ঢাকা উত্তর সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন শিমুল টিবিএসকে জানান, ঢাকা উত্তরের ১০টি অঞ্চলের প্রতিটিতে ১টি করে কুইক রেসপন্স টিম কাজ করছে। আর প্রতি টিমে কমপক্ষে ১০ জন করে কর্মী রয়েছেন।
"রোকেয়া স্মরণি, বনানীর রাস্তায় পানি একটু বেশি সময় জমেছিল। শুক্রবার সকাল ১১ টার মধ্যেই এ পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হয়েছে। তবে কিছু গলির ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এখনও কিছু এলাকার গলির রাস্তায় পানি জমে আছে। বিশেষ করে, নতুন সংযুক্ত ওয়ার্ডগুলোতে এখনও পানি জমে আছে," বলেন তিনি।
এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটির নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আমার আওতাধীন এলাকা খিলগাঁওয়ে আমি সকালে লোক পাঠিয়েছি, কিন্তু কোনো পানি জমে থাকতে দেখিনি। যেসব এলাকায় পানি জমে আছে, সেগুলো আমার আওতাধীন নয়।"
ঢাকা দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা বাবর আলী মীর টিবিএসকে বলেন, "আমার এলাকা আজিমপুরে কোনো জলাবদ্ধতা হয়নি।"
অন্যদিকে, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত এলাকার আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (অঞ্চল-১) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
যদিও বৃহস্পতিবার রাতের বৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আজিমপুর ও নীলক্ষেত এলাকায়ই সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধ সৃষ্টি হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মুখপাত্র ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাসের টিবিএসকে বলেন,"আমার কাছে জলাবদ্ধতার কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো আপডেটও নেই। আমি নিজে থেকেও কর্মকর্তাদের ফোন দিয়ে তাদের পাইনি।"
ঢাকাবাসীর জন্য এক অসহনীয় রাত
বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকা শহরে ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় পুরো শহরের বেশিরভাগ রাস্তা। রাতে যাতায়াত করা শহরবাসীকে এক আতঙ্কের মধ্য দিয়ে নিজ গন্তব্যে যেতে হয়েছে।
"আমি ট্রান্সপোর্টের জন্য আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করি অফিসের সামনে। শেষমেশ রাত ২টায় যেয়ে বাসায় পৌঁছাই," বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত ইয়াসমিন সুলতানা এভাবেই গত রাতের (২১ সেপ্টেম্বর) অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে।
তিনি বলেন, "বাড্ডা এলাকায় কোমর পর্যন্ত গভীর পানি ছিল। রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর একটি সিএনজি পাই আমি।"
বেসরকারি চাকরিজীবী শারমিন আক্তার বলেন, "কাল রাত ৯টায় আমি অফিস থেকে বের হই, অফিসের নিচের রাস্তায় তখন পানি জমে গেছে, হাঁটার উপায় নেই। অফিস থেকে বের হয়ে একটি রিকশা পাই, তখন বৃষ্টি কিছুটা কম। তবে রিকশা মগবাজার সিগন্যালে যাওয়ার পর শুরু হয় তীব্র বৃষ্টি। আধাঘণ্টার মত সিগন্যালে থাকতে হয়েছে।"
"এরপর শুরু হয় মূল ভোগান্তি। নয়াটোলা, মধুবাগের রাস্তায় পানি জমে গেছে, রিকশা-গাড়ি সব থেমে থাকছে বেশি, চলছে কম। আবার কখনো রাস্তার উল্টোপাশ দিয়ে বড় কোন গাড়ি ঢুকে আটকে গেছে গলির মুখে। রিকশা একটু এগুলে দশ মিনিট দাড়িয়ে থাকে। এভাবেই পৌনে ১১টার দিকে বাসায় ফিরি। সাধারণত আমি রিকশায় ৮০ টাকা ভাড়া দিয়ে ফিরলেও গতকাল ৩০০ টাকা ভাড়া দিয়েছি," বলেন তিনি।
রাত পৌনে ১১টার দিকে রাস্তায় থাকা শেখ সাব্বির নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন, "সড়কগুলোতে পানি জমে ছিল কোন কোন জায়গায় এক থেকে দুই ফুট। বিশেষ করে আমি যখন বাসায় ফিরি তখন দেখলাম শান্তিনগর মোড়ে দুই ফুটের মতো পানি জমে আছে। সেখানে কয়েকটি গাড়ি নষ্ট হয়ে দাড়িয়েছিল। সাত আটটা সিএনজি, একটা মাইক্রোবাস দাঁড়ানো দেখলাম।"
"নষ্ট গাড়িগুলোর জন্য শান্তিনগর মোড়ে জ্যাম হচ্ছিলো যথেষ্ট। সেখান থেকে এসে শাহজাহানপুর মোড়েও জ্যাম দেখলাম। অনেক মানুষ রাস্তার পাশে শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল," বলেন তিনি।
অত্যধিক বৃষ্টির পানিতে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতেও পানি ঢুকে পড়ে। এলিফ্যান্ট রোডে দোকানদারদেরকে রাতে বালতি দিয়ে দোকান থেকে পানি বের করতে দেখা গেছে।
বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় অনেকেই নিজেদের বাড়িতে না যেয়ে কাছাকাছি পরিচিত কারো বাড়িতে রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তাছাড়া, সপ্তাহান্তে আগে থেকে ঠিক করে রাখা ভ্রমণের জন্য বাস বা ট্রেনও মিস করেন অনেকে।
রাস্তায় পানি জমে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা যানবাহনগুলোর জন্য তীব্র জ্যাম সৃষ্টি হওয়ায় নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে সচরাচর সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ সময় লেগেছে নগরবাসীর।
জ্যামে আটকে থাকা অনেককেই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে তাদের অবস্থা জানাতে দেখা যায়।
অথচ, গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, অতিবৃষ্টি হলেও আগামী বর্ষায় ১৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
তখন তিনি বলেন, "রাজধানীর খালগুলো ওয়াসা থেকে হস্তান্তরের পরে প্রথম বছরে (২০২১ সাল) আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে পানি নিষ্কাশনে সফল হয়েছি। গত বছর আমরা আধা ঘণ্টার মধ্যে পানি নিষ্কাশনে সফল হয়েছি। এবার আমাদের লক্ষ্যমাত্রা হলো, অতিবৃষ্টি হলেও ১৫ মিনিটের মধ্যেই যেন ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে পারি।"
এদিকে, ঢাকা কলেজের ছাত্র ইমরান হোসেন শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে নিউমার্কেটে যাওয়ার জন্য রওনা হন। তিনি বলেন, তিনি যে আবাসিক হলটিতে থাকেন তার সামনে হাঁটু পানি ছিল।
এমনকি পানি নিষ্কাশনের জন্য শহরজুড়ে বসানো পানির পাম্পগুলোও খুব একটা কাজে আসেনি।
ঢাকা উত্তর এলাকায় জমে থাকা পানি নিরসনে বর্তমানে কল্যাণপুরে পাঁচটি পাম্প চালু রয়েছে উল্লেখ করে পাম্প অপারেটর মাসুম বলেন, "পাম্প এলাকায় পানির উচ্চতা বিপদসীমা ছাড়িয়ে ৫ মিটারে উঠেছে। যদি ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকে, তাহলে পাম্প করা ও পানি নিষ্কাশন করা চ্যালেঞ্জিং হবে।"
এদিকে আবহাওয়াবিদ ডক্টর মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক টিবিএসকে জানান, শুক্রবার রাত ১২টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় কোনো বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়নি। তবে আগামী কয়েকদিন বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বাড়তে পারে।
আগামী তিন দিন বৃষ্টি হবে এবং এর পরিমাণ বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জায়গায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়বে।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের আরেক পূর্বাভাসে বলা হয়, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও, সারাদেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে রংপুরের ডিমলায় ১৪৯ মিলিমিটার এবং ঢাকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।