তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধে নতুন ফর্মুলার পরিকল্পনা সরকারের, দাম বাড়বে বিদ্যুতের
ডলারের বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতার কারণে ফার্নেস তেল আমদানির লোকসান কাটাতে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সাহায্য করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এই বাড়তি ব্যয়ের বোঝা বইতে হতে পারে ভোক্তাদের।
ফার্নেস তেলভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে (আইপিপি) তেল আমদানির এলসি খোলার সময়কার বিনিময় হারের বদলে ফুয়েল পেমেন্টের সময়কার বিনিময় হারে পেমেন্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণে এই ট্রু-আপ পেমেন্ট ব্যবস্থাটি—তেল কেনার সময়কার ও পেমেন্টের সময়কার মূল্যের পার্থক্যের সমন্বয় করার জন্য কৃত পেমেন্ট—বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ এবং এ খাতে সরকারের ভর্তুকি ও ব্যয়ের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) জন্য মতামত চেয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রতিটি আইপিপির সঙ্গে পৃথক চুক্তি করবে বিপিডিবি। আইপিপিগুলো গত বছরের জানুয়ারি থেকে নতুন চুক্তি কার্যকর করতে সরকারকে অনুরোধ করেছে।
এ চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে বিপিডিবিকে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল বিলম্বে পরিশোধ করার দায়ে সরকারের কাছে দণ্ডসুদ চেয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রসিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা)।
এ বিষয়ে সম্মতি দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগে প্রস্তাব দিয়েছে বিপিডিবি। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে দণ্ডসুদ পরিশোধের উদ্যোগ নেবে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিপ্পা বলেছে, একদিকে বিলম্বিত পেমেন্ট অপরদিকে বিনিময় হারের ওঠানামার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে কোম্পানিগুলো অনিশ্চিত আর্থিক অবস্থানে পড়ে গেছে। এতে অনেক কোম্পানি তাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের ঋণসীমার প্রান্তে পৌঁছে গেছে।
বিপ্পার সভাপতি ফয়সাল খান বলেন, 'আমাদের সব সদস্য কোম্পানি যারা ফার্নেস তেল আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তারা ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিপিডিবির অর্থ প্রদানে ব্যাপক বিলম্বের কারণে এই ক্ষতি আরও বেড়ে গেছে। এখন টাকার আরও অবমূল্যায়নের পূর্বাভাস পেয়ে যেসব ব্যাংক এলসি খোলে, তারা নতুন এলসি খুলতে চাইছে না। ব্যাংকগুলো জানতে পেরেছে যে কিছু বিদ্যুৎ কোম্পানির ভবিষ্যতে এই বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষতি পূরণের আর্থিক সক্ষমতা নেই।'
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) অনুযায়ী ফার্নেস তেলভিত্তিক আইপিপিগুলো বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আগাম অনুমতি নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী নিজেরা ফার্নেস তেল আমদানি করে সাতদিনের মধ্যে বিপিডিবিতে ইনভয়েস জমা দেবে। তার ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে বিপিডিবি বা সরকার বিল পরিশোধ করবে।
নিয়মানুযায়ী, আইপিপিগুলো বিপিডিবিতে বিল জমা দেওয়ার পর তা যাচাই-বাছাই করে বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হয়। বিদ্যুৎ বিভাগ তা যাচাই করে ভর্তুকির অর্থ ছাড় করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠালে অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ছাড় করে, যা বিপিডিবি আইপিপিগুলোকে পরিশোধ করে। এতে প্রায় দুই মাস সময় লাগত।
কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে আর্থিক সংকট দেখা দেওয়ার পর থেকে এই বিল পরিশোধে বাড়তি সময় নিচ্ছে সরকার। সরকার এখন বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধ করতে প্রায় পাঁচ মাস পিছিয়ে আছে। অর্থবিভাগের কাছে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিল এসে জমা আছে।
এখনও গত বছরের সেপ্টেম্বরের ভর্তুকির পুরো অর্থ ছাড় হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভর্তুকি চাহিদা এসেছে ৪ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থবিভাগ।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যার পুরোটা গত অর্থবছরের ভর্তুকি মেটাতে ব্যয় হবে। আর চলতি অর্থবছরের ভর্তুকির চাহিদা মেটাতে হবে আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ থেকে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে সরকারের করা ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তিতে ২০২৬ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই বাড়তি ব্যয় চূড়ান্ত বিচারে ভোক্তাদেরই বহন করতে হবে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিনিময় হার ওঠানামা করার কারণে বাড়তি পেমেন্টের প্রয়োজন হলে তার দায় সরকারকেই নিতে হয়। বিদেশি কোম্পানির পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও সরকার এ নিয়ম অনুসরণ করে।
বিপ্পার সাবেক সভাপতি ইমরান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় গত অর্থবছরে ফার্নেস তেলভিত্তিক আইপিপিগুলোর প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। আইপিপিগুলোর সঙ্গে সরকারের আগের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) করার সময় ডলারের দাম এখনকার চেয়ে অনেক কম ছিল।
'এখন প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দেওয়ার পর বিপিডিবি ও জ্বালানি বিভাগ আইপিপিগুলোর সঙ্গে পৃথক চুক্তি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর যেসব বিল সরকার পরিশোধ করবে, সেক্ষেত্রে পরিশোধকালীন সময়ের বিনিময় হার অনুযায়ী টাকা দেবে। ফলে আইপিপিগুলোর নতুন করে আর লোকসান গুনতে হবে না। তবে পুরোনো লোকসান থেকেই যাবে,' বলেন তিনি।
ইমরান করিম আরও বলেন, ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। তাই এই খাতে ধস নামলে ব্যাংকিং খাতেও ধস নামবে। দেশের দু-তিনটি ব্যাংক তাৎক্ষণিকভাবে ধসে পড়বে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য বছরে ৫ মিলিয়ন টনের বেশি ফার্নেস তেল লাগে, যার প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন টন সরাসরি বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ নিজেরাই আমদানি করে।
ইমরান করিম বলেন, 'পিডিবির সঙ্গে আইপিপিগুলোর স্বাক্ষরিত পিপিএ অনুযায়ী, সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে বিলম্বে পরিশোধের দায় হিসেবে সুদসহ বকেয়া বিল পরিশোধ করবে। তেল, গ্যাস আমদানির বিল সময়মত পরিশোধ করতে না পারলে বিদেশি সাপ্লায়রকে সুদসহ তা পরিশোধ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে চুক্তিতে এ নিয়ম থাকলেও সরকার থেকে কোন সুদ দেওয়া হচ্ছে না।'
'সময়মতো বিল পরিশোধ করতে না পারলে বিলম্ব সুদ চেয়ে আমরা বিপিডিবিকে চিঠি দিয়েছি,' বলেন তিনি।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ফার্নেস তেলভিত্তিক আইপিপির সংখ্যা ৩৩টি। এসব কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ৫ হাজার ৮৫১ মেগাওয়াট।