সব প্রকল্পেই পানি সরবরাহ নিশ্চিতে অবহেলা, পানি সংকটের মুখে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার
সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত না করেই ব্যাপক শিল্পায়ন ও উন্নয়ন কাজ চলছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে, যা শীঘ্রই গুরুত্বপূর্ণ চলমান প্রকল্পসমূহ ও এই বৃহত্তর অঞ্চলের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিদ্যুৎ হাব, লজিস্টিক হাব, পর্যটন জোনসহ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে সমান তালে। ফলে মানুষ, সেচ ও শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য আঞ্চলিক নদী ও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপক নির্ভরতা তৈরি হয়েছে।
কর্ণফুলী নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় সব ধরনের ব্যবহারের জন্য পানি সরবরাহের সমস্যা জটিল হয়ে আকার ধারণ করেছে। বন্দর নগরীতে পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা সংস্থা চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রায়ই শিল্প ও সেবা খাতের পানির চাহিদা মেটাতে পারছে না।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই সমস্যা দ্রুত সুরাহা করার আশ্বাস দিলেও বিশেষজ্ঞরা প্রকল্প নেওয়ার আগে পানির উৎসের ওপর গুরুত্ব দিতে বলছেন।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি বন্দরই ইঙ্গিত দিচ্ছে ভবিষ্যতে পানি সমস্যা কতটা খারাপ আকার নিতে পারে। এ বন্দরে প্রায় ১৪০টি জাহাজ ভিড়েছে গত দুই বছরে। এসব জাহাজে মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রর কাঁচামাল ও নির্মাণসামগ্রী আনা হয়েছে। এসব জাহাজ এবং নির্মাণাধীন বন্দরের চাহিদা পূরণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানি সরবরাহ জাহাজে করে সুপেয় পানির সরবরাহ করা হচ্ছে বর্তমানে। মূলত স্থানীয়ভাবে পানির সংস্থান করতে না পেরে জাহাজে করে পানি সরবরাহ করতে হচ্ছে।
২০২৬ সালে গভীর সমুদ্রবন্দরটি চালু হলে পানির চাহিদা বাড়বে। তখন পানির সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে ২০২৬ সালের মধ্যে মাতারবাড়ির জন্য পানি শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-সংরক্ষক ফরিদুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বর্তমানে বছরে ৪ হাজার জাহাজ ভিড়ে দেশের প্রধান এই বন্দরে। ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে ২০৪০ সালে বন্দরে জাহাজ ভিড়বে প্রায় ৮ হাজার।
বর্তমানে বন্দরের দৈনিক পানির চাহিদা ৮০০ টন (২৫ হাজার ৪০৩ গ্যালন) বলে জানান তিনি। এই পানির সংস্থান হয় চট্টগ্রাম ওয়াসা ও গভীর নলকূপ থেকে।
ফরিদুল বলেন, 'মহাপরিকল্পনা অনুসারে পানি শোধনাগার স্থাপন করা হবে। আশা করছি, পানির সংকট হবে না।'
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম ফজলুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পানিকে গুরুত্বে নেওয়া হয় না। এ কারণে পরে সংকট দেখা দেয়।'
ফজলুল্লাহ বলেন, বর্তমানে সমুদ্রবর্তী অঞ্চল চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। শিল্পায়নের জন্য পানি প্রয়োজন। আগের মতো গভীর নলকূপ বসিয়ে বা নদী থেকে পানি নিয়ে শোধনের পর ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
'এজন্য প্রকল্প গ্রহণ বা বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করার আগে পানির সংস্থান নিশ্চিতের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে,' বলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর
চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি বলেন, পানির সংকট বড় বিনিয়োগকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে—এর নিকট উদাহরণ হলো দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পাঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় ৩০ হাজার একর জমিতে গড়ে ওঠা এই শিল্পাঞ্চলের প্রধান সমস্যা পানির সংকট।
বর্তমানে এখানে পাঁচটি শিল্প ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে এবং ১৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন রয়েছে। এ শিল্পনগরে ২০২৩ সালের মধ্যে আরও তিনটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করবে।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, পুরো শিল্পাঞ্চলে ২০২৫ সালে দৈনিক অপরিশোধিত পানির চাহিদা দাঁড়াবে ৩৬৪ মিলিয়ন লিটার (এমএলডি); ২০৩০ সালে ৫১৬ এমএলডি, ২০৩৫ সালে ৭৩০ এমএলডি ও ২০৪০ সালে ১,০৩৩ এমএলডি হবে।
চাঁদপুরের মেঘনা নদী থেকে রেলট্র্যাকে ১৩২ কিলোমিটার পাইপলাইন বসিয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানি সরবরাহে ওয়াসার মাধ্যমে কাজ করতে একটি কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান আগ্রহী। এটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পটির সাম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলেও তা হবে সময়সাপেক্ষ।
এছাড়া ফেনী নদী থেকে পানি সরবরাহ, গভীর নলকূপ থেকে উত্তোলন এবং সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা দূর করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল
দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা মিরসরাইয়ের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলও পানি সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইপিজেডে অনেক প্রতিষ্ঠান পানির সমস্যার কারণে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এরমধ্যে চলতি বছর বড় আকারের বিনিয়োগ নিয়ে আসা টেক্সটাইল খাতের দুটি প্রতিষ্ঠান ফিরে গেছে।
পানির সরবরাহ নিশ্চিত হলেও দূরবর্তী মেঘনা নদী থেকে পানি এনে এখানে সরবরাহ করা হলে অন্যান্য ইপিজেড থেকে পানির খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
বর্তমানে অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে ১৩৫টি (২৩ শতাংশ) প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ এনামুল হক এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি টিবিএসকে জানান, এই ইপিজেডে ড্রাই ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিপরীতে অধিক পানির প্রয়োজন এমন ইন্ডাস্ট্রিকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু টানেল
দক্ষিণ চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। এ অঞ্চলের পর্যটনের উন্নয়নে আনোয়ারা উপজেলার পারকি বিচে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির অধীনে আধুনিক কটেজ, পিকনিক শেড, রেস্তোরাঁ, কনভেনশন হল, ওয়েটিং রুম, কার পার্কিং জোন সুবিধাও রাখা হয়েছে। কিন্তু সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারায় প্রকল্পটির কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও পর্যটন কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রকল্প এলাকায় পানি সরবরাহের বিষয়ে একমত হতে পারেনি।
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ত) ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, 'প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত আছে। পানির সমস্যা সমাধানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কাজ করছে।'
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আয়েশা আক্তার বলেন, প্রকল্প শুরুর আগেই ভালো করে সবদিক মূল্যায়ন প্রয়োজন। ছোট পরিসরে হলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত। 'যেহেতু প্রকল্পগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য, তাই ভবিষ্যৎকে বিবেচনায় নিতে হবে।'
আগামী দিনের পানি সংকট
চট্টগ্রামের ১২টি শিল্পাঞ্চলের মধ্যে সরকারি অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কর্ণফুলী ড্রাইডক স্পেশাল ইকোনমিক জোন স্থাপন কাজ চলছে। চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড পুরোদমে চালু হয়েছে। আর কোরিয়ান ইপিজেডে নতুন কারখানা হচ্ছে।
সরকারের জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ অনুসারে, শিল্পাঞ্চলের কারণে আগামী ২০ বছরের মিরসরাই অঞ্চলে ৩.২ মিলিয়ন মানুষের আগমন ঘটবে। তখন পানির চাহিদা হবে দৈনিক ৬৪ কোটি লিটার।
এ অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে ভারী শিল্প কারখানার কার্যক্রম চলছে। গভীর নলকূপ দিয়ে ভূর্গস্থ পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর নামছে। আর পানির মধ্যে আর্সেনিক ও লবণের উপস্থিতি রয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে, গত ৪০ বছরে চট্টগ্রামের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০ মিটার নেমে যাওয়ায় জেলার ৭৫ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পানি সংকটে ভুগছে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অনুসারে, কক্সবাজার জেলা ও আশপাশের এলাকার জনসংখ্যা ২০২৬ সালে প্রায় ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার বাড়তে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, টেকনাফ পৌরসভা ও উপজেলায় পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। গভীর লনকূপ স্থাপনের জন্য কিছু ক্ষেত্রে ১ হাজার ফুট পর্যন্ত খনন করতে হয়। সুপেয় পানিতে লবণাক্ততার কথাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি একেএম ফজলুল্লাহ টিবিএসকে জানান, সংস্থাটির আওতাধীন এলাকা শুধু চট্টগ্রাম নগরী।
'পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সার্বিক পানির সংকট নিয়ে কাজ করছে জাইকা। তারা বিস্তারিত সাম্ভাব্যতা যাচাই করছ,' বলেন তিনি।
ডিস্যালিনেশন কি সমাধান হতে পারে?
শুধু মানুষ নয়, শিল্প খাতেও সুপেয় পানি ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। কারণ লবণাক্ত পানিতে মেশিন ক্ষয় হয়ে যায় এবং পণ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হতে পারে।
শিল্প খাতে পানির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় স্বাদু পানির উৎসের ওপর আশঙ্কাজনক চাপ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শিল্প খাতে ও মানুষের ব্যবহারের জন্য সাগরের পানিকে পরিশোধন করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হয়ে উঠেছে ডিস্যালিনেশন বা লবণাক্তটা দূরীকরণ। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এশিয়া, এমনকি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার অনেক দেশও স্বাদু পানির ওপর গুরুতর চাপ কমানোর জন্য ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্টের আশ্রয় নিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে পানির ঘাটতি ভালোমতোই বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সারা বিশ্বেই বিশেষজ্ঞরা সমুদ্রের পানি ডিস্যালিনেশনকে একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে দেখেন। এখনও ব্যয়বহুল হলেও, প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে ডিস্যালিনেশনের খরচ ধীরে ধীরে অনেকটাই কমে এসেছে। শিল্প খাতের তথ্য বলছে, সমুদ্রের পানিকে গ্রহণযোগ্য মানের পানিতে পরিশোধনের জন্য বড় প্ল্যান্টে গড় খরচ হয় প্রতি এক হাজার গ্যালনে প্রায় ২.৬৫ ডলার, আর ছোট প্ল্যান্টে এই খরচ কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি এক হাজার গ্যালনে ৪.৭৫ ডলার।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে যে পরিমাণ পানির চাহিদা হতে পারে বলে হিসাব করা হয়েছে, তাতে এ শিল্পাঞ্চলের জন্য সমুদ্রের পানি শোধন করতে চাইলে খুব বড় একটি প্ল্যান্টের প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে একটি ছোট প্ল্যান্টেই চট্টগ্রাম বা মাতারবাড়ি বন্দরের কাজ চলে যাবে।