নতুন বিনিয়োগে চট্টগ্রামের ফার্নিচার শিল্পে ফের আশার সঞ্চার
দুই দশক আগেও দেশের ফার্নিচার শিল্পের প্রায় অর্ধেক ছিল চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমার থেকে আসা কাঠ ছিল দেশের ফার্নিচার শিল্পের প্রধান কাঁচামাল। পরবর্তীতে অবশ্য ঢাকা-কেন্দ্রিক ফার্নিচার কারখানায় প্রসেসড উডের ব্যবহার ও উন্নত প্রযুক্তির কাছে পিছিয়ে পড়লেও সম্প্রতি আবার পুনরুজ্জীবনের শুরু হয়েছে চট্টগ্রামের ফার্নিচার শিল্পে।
বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বড় বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে এ খাতে। ক্লাসিক্যাল ঘরানার সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে আবারও ফার্নিচার খাতে শক্ত অবস্থান গড়ছে চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির যুগ্ম সচিব মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, জেএমজি ফার্নিচার, শৈলপিক ফার্নিচার, ভেগাস ফার্নিচার, আনন্দ ফার্নিচার, পিটুপি ফার্নিচারসহ অন্যান্য কোম্পানিগুলো এ বছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এবং নির্বাচনের পর আরও ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ফার্নিচার শিল্পের ঐতিহ্য দেড়শ বছরের পুরনো। মাত্র দুই দশক আগেও দেশের প্রায় অর্ধেক ফার্নিচার কারখানা ছিল চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক।
কর্ণফূলী নদীর যোগাযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাকলিয়ার বলীরহাটে এই শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। যেখানে কাঠ আসা হয় মিয়ানমার থেকেও। আশির দশকে শিপব্রেকিং শিল্পের প্রসার চট্টগ্রামের ফার্নিচার শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
"কিন্তু ২০০০ সালের পর নতুন বিনিয়োগের অভাব ও প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে যান চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা, যার প্রভাব পড়ে প্রতিযোগীতামূলক বাজারে। বিশেষ করে, ঢাকা-কেন্দ্রিক ফার্নিচার কারখানাগুলো প্রসেসড উডের ব্যবহারের কাছে মার খেয়ে যায় চট্টগ্রামের কাঠের ফার্নিচার। তবে আসার কথা হচ্ছে, চট্টগ্রাম আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। করোনা পরিস্থিতির মাঝেও ফার্নিচার খাতে বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান এই খাতে বিনিয়োগ করেছে," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতি, চট্টগ্রাম বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আমদানিকৃত প্রসেস উড ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে ফার্নিচার তৈরি করছে চট্টগ্রামে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০টি। শিপ ইয়ার্ডের ফর্নিচার প্রসেসিং করে বিক্রি করে ২০০'র বেশি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া চট্টগ্রামের বলীরহাট, আসকার দিঘি, দেওয়ানবাজার, মুরাদপুর ও ফৌজদারহাটে রয়েছে অন্তত এক হাজার ফার্নিচার তৈরির প্রতিষ্ঠান।
আসবাবপত্র ব্যবসায়ীদের এই সংগঠন বলছে, সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে ফার্নিচার শিল্পের বার্ষিক লেনদেন ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
বলীরহাটের ফার্নিচারের কদর সারাদেশে
কর্ণফুলী নদীর তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা ফার্নিচার পল্লী বলীর হাট প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো। তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা আসবাব পল্লীর বেশির ভাগ ব্যবসায়ী বাপ-দাদাদের হাত ধরেই এই ব্যবসায়ে এসেছেন। সস্তা ও টেকসই আসবাবের জন্য বলীরহাটের কদর যেমন আছে, তেমনি এখানকার আসবাবের সূক্ষ্ম কারুকাজেরও জুড়ি নেই। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী এখানকার কারখানা গুলোতে তৈরি করা হয় নজরকাড়া আকর্ষণীয় ডিজাইনে আসবাব। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার লেনদেন হয় এই ফার্নিচার বাজারে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নগরের বহদ্দারহাট থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নদীর তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা এই ফার্নিচার বাজারে সারি সারি দোকান। কান পাতলে শোনা যায় কাঠ খোদাইয়ের ঠুক ঠুক শব্দ। দোকানে দোকানে শোভা পাচ্ছে নকশা করা কাঠের চেয়ার, খাট, আলমারি, বুকশেলফ আর সোফা। প্রসেসড উডের এই সময়ে বলীরহাটে শুধু কাঠের আসবাবেরই দেখা মিলল।
দোকানিরা জানান– সেগুন, কড়ই, গর্জন ও গামারী কাঠের আসবাব তৈরি হলেও চাহিদা বেশি সেগুন কাঠের আসবাবের।
ফার্নিচার ব্যবসায়ী আকবর হোসেনের বলেন, "বাবার হাত ধরে তিন ভাই ফার্নিচার ব্যবসায়ে এসেছিলাম তিন যুগ আগে। আমাদের মতই বংশ পরম্পরায় বাকলিয়া এলাকার অন্তত তিন হাজার পরিবার এ ব্যবসায় জড়িত।"
ঐতিহ্যগতভাবে বলীরহাটের ফার্নিচারের আলাদা কদর রয়েছে। বিয়ের উপহার ও নবদম্পতির সংসার সাজাতে বলীরহাটের ফার্নিচারের রয়েছে আলাদা আবেদন। এছাড়া, এখান থেকে সারাদেশের অনেক বড় বড় শো-রুমে সরবরাহ করা হয় ফিনিশড ও আনফিনিশড ফার্নিচার।
বলিরহাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মজিবুর রহমান বলেন, "প্লাইউডের ব্যবহারের কারণে সারাদেশে প্রাকৃতিক কাঠের আসবাবের চাহিদা কমেছে। তবে ঐতিহ্যগত কারণে বলীরহাটের ফার্নিচারের দাম একটু বেশি হলেও চাহিদায় কখনো কমেনি।"
"দিন যতই যাচ্ছে উন্নত হচ্ছে ফার্নিচার তৈরির সরঞ্জাম। আগে যেসব কাজ হাত দিয়ে করা হতো, এখন সেসব কাজ করা হচ্ছে মেশিনের মাধ্যমে। আধুনিকতার ছোঁয়া যেমন লেগেছে, অন্যদিকে চাকরি হারাচ্ছে নকশা, কারুকাজের শিল্পীরা," যোগ করেন তিনি।
আসছে নতুন বিনিয়োগ, টার্গেট বিদেশের বাজার
শ্রমিকের প্রাচুর্য, পুঁজির প্রবাহ, প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং বিশ্ববাজারে উচ্চ চাহিদার কারণে ফার্নিচার খাতকে বাংলাদেশের একটি প্রতিশ্রুতিশীল খাত হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
২০২২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশে গার্মেন্টস সেক্টরের পরে ফার্নিচার সেক্টর দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মক্ষেত্র; যেখানে প্রায় ২০ লাখ লোক কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের ফার্নিচার শিল্পের বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার, যা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১.২ শতাংশ। ৪০ হাজারেরও বেশি ছোট-বড় কোম্পানি ফার্নিচার উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত।
দেশে ফার্নিচার খাতের এই অগ্রগতির সঙ্গে এগিয়েছে চট্টগ্রামও। গত পাঁচ বছরে ফার্নিচার শিল্পে শৈল্পিক ফার্নিচার, ভেগাস ফার্নিচার, জিএমজি, আনন্দ ফার্নিচার ও পিটুপি'র মতো ব্রান্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।
জিএমজি ফার্নিচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, "চট্টগ্রামের ফার্নিচার শিল্পটা এখন একটি গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগেও মানুষ ভালো ফার্নিচারের জন্য আমদানি করা ফার্নিচারের ওপর নির্ভরশীল ছিল অথবা ঢাকাই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেছে নিতো। চট্টগ্রামের অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান ফার্নিচার রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছে।"
আসবাবপত্রের মধ্যে চট্টগ্রামের ব্র্যান্ড হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছে শৈল্পিক। প্রতিষ্ঠানটির আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চের ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান আদনান বলেন, "আসবাবপত্র ব্যবহারে মানুষের ধ্যান ধারণায় বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন মানুষ কোনো আসবাবপত্ৰ ৫ থেকে ১০ বছরের বেশি ব্যবহার করতে চান না। আমরা আমাদের ফার্নিচার তৈরির ক্ষেত্রে এটিকে গুরুত্ব দিয়েছি। ফলে খুব দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।"
ভেগাস ফার্নিচারের চেয়ারম্যান ও ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইফুদ্দিন চৌধুরী দুলাল। সম্প্রতি তিনি চট্টগ্রামের হালিশহরে প্রায় ৪০ হাজার বর্গফুট আয়তনের একটি নতুন ফার্নিচার কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন; যেখানে ২০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তার বর্তমান কারখানায় কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ২৫০ জন।
তিনি বলেন, "বিশ্বে বর্তমানে অনেক ধরনের আসবাব তৈরি হয়, যার অধিকাংশই হাতের স্পর্শ ছাড়াই হয়ে থাকে। তবে হাতের স্পর্শ আছে এমন আসবাবের ভালো চাহিদা রয়েছে। আমেরিকা-কানাডাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বাংলাদেশের ফার্নিচারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আমাদের এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।"