ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আছে ১১ গিগাওয়াট পিক বিদ্যুতের সম্ভাবনা
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভাসমান সৌরকোষের মাধ্যমে ১১ হাজার মেগাওয়াট পিক (বা ১১ গিগাওয়াট পিক) বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের। ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিভিন্ন জলাশয়, জলাধারের ওপর গড়ে তোলা যায়, দেশে ভূমি-ভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ গড়ে তুলতে জমির পরিমাণ সীমিত হওয়ায়, এটি একটি ভালো উপায়ও।
বাংলাদেশের ২৫ হেক্টরের চেয়ে বড় এমন ৩২৩টি জলাশয়ের সম্ভাবনা যাচাই করে এ হিসাব করেছে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)।
গত ৭ সেপ্টেম্বর এক কর্মশালায় এ গবেষণার ফলাফল– বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়; পানি-সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানায় আইএফসি।
এরপর গত ১৬ অক্টোবর নরওয়ে দূতাবাসে আয়োজিত এক সেমিনারে আবারো গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের ২০৩০ ওয়াটার রিসোর্সেস গ্রুপের আঞ্চলিক প্রধান সায়েফ তানজিম কাইয়ুম বলেন, 'ফ্লোটিং সোলার পিভি (এফএসপিভি) বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যগুলোর অর্জনের বাস্তবসম্মত ও খরচ-সাশ্রয়ী উপায় হতে পারবে।'
বাংলাদেশে ইউটিলিটি বা পরিষেবা পর্যায়ে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে আইএফসি প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তবে পরিবেশ ও পানিসম্পদ– এ দুই মন্ত্রণালয় – জলজ প্রাণী ও তাদের বাস্তুসংস্থানের ওপর ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা– সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
যদিও আইএফসির গবেষণার ফলাফলকে ইতিবাচক বলেই উল্লেখ করেন বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান।
তিনি বলেন, আইএফসি এখন একটি বা দুটি পাইলট প্রকল্প নেওয়ার কথা ভাবছে, সরকারও তাদের সমর্থন দিতে প্রস্তুত আছে।
তবে সৌরশক্তি কাজে লাগানোর এই সম্ভাবনা বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সৌরবিদ্যুতের পূর্ণ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমাদের বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। কিন্তু, ভাসমান সোলার প্রকল্প নিয়ে বর্তমানে তাদের মধ্যে আগ্রহ বেশ সীমিত।'
স্থানীয় ও বিদেশি কয়েকটি কোম্পানি সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছে। যেমন গত আগস্টে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করেছে বেক্সিমকো পাওয়ার। এ ছাড়া, খুলনায় ১৩৪ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে ওরিয়ন গ্রুপ।
অগ্রাধিকারে থাকা ১০ প্রকল্পের স্থান
৩২৩টি জলাশয়ের ওপর অধ্যয়ন করে আইএফসি ১০টি বাওড়, বিল ও হ্রদকে অগ্রাধিকারযোগ্য প্রকল্প স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে, যেগুলোর প্রায় ১০.৮ গিগাওয়াট পিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
এরমধ্যে দুটি জলাশয় মানবসৃষ্ট – বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি হ্রদ এবং রাঙ্গামাটি জেলায় কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের হ্রদে – যথাক্রমে ২০ মেগাওয়াট পিক এবং ১০ হাজার ৭২ মেগাওয়াট পিক সক্ষমতার ভাসমান সৌরকোষ স্থাপন করা যাবে।
বাকি আটটি বাওড় ও বিল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এগুলো হলো– জয়দিয়া বাওড়, বালুহর বাওড়, মারজাত বাওড়, কাটগরা বিল, বেরগোবিন্দপুর বাওড়, বুকভরা বাওড়, মাজদিয়া বাওড় এবং ঝাপা বাওড়। এসব জলাশয়ে ২৩ থেকে ৮৩ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী আইএফসি
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়, ২০১৮ সাল থেকে শুরু করা ক্লাইমেট-স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট অপরচ্যুনিটির অংশ হিসেবে ২০৩০ সাল নাগাদ ১৭২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ। এরই অংশ হিসেবে বৈশ্বিক দাতাসংস্থাটি বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ- জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে অত্যন্ত আগ্রহী।
ইতোমধ্যেই খুলনা জেলায় ৩০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলতে সহায়তা দিতে বাংলাদেশের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)-র সাথে একটি চুক্তি করেছে।
বৈশ্বিক অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান আইএফসি বাংলাদেশের ইউটিলিটি পর্যায়ের সৌর প্রকল্পগুলোয় অর্থায়নের জন্য বেশকিছু স্পন্সরদের সাথেও সক্রিয়ভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
পরীক্ষামূলকভাবে চা বাগানগুলোয় সৌরকোষ স্থাপনের সম্ভাবনা যাচাইও করছে আইএফসি।
বাংলাদেশে ভাসমান সৌরবিদ্যুতের উৎপাদনের চিত্র
২০৩০ সাল নাগাদ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে করার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু, এই সক্ষমতার মাত্র ৪ শতাংশ এপর্যন্ত অর্জিত হয়েছে।
২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৮ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে– সৌরবিদ্যুৎ সক্ষমতা মাত্র ১ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সিংহভাগ উদ্যোগই বর্তমানে সৌরশক্তি-ভিত্তিক, যারমধ্যে রয়েছে হোম সোলার সিস্টেম, সোলার পার্ক ও ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন।
দেশে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ তেমন ছিল না বললেই চলে, তবে এ বছরের মে মাসে প্রথম এ ধরনের একটি প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। চাপাইনবাবগঞ্জের বুলনপুরে গড়ে তোলা এ কেন্দ্রের সক্ষমতা ২.৩০ মেগাওয়াট।
বর্তমানে জাপানের সুমিতোমো কর্পোরেশন ও পার্কার বাংলাদেশ ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি এলাকায় নির্মাণাধীন এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে ভাসমান সোলার প্যানেল থেকে, আর বাকি ১৫০ মেগাওয়াট যোগান দেবে ভূমি-ভিত্তিক সোলার প্যানেল।