চট্টগ্রামে ১৫০ শয্যার বার্ন ইউনিটের কাজ শুরু হবে শিগগিরই
চীনের অর্থায়নে চট্টগ্রামে ১৫০ শয্যার একটি বিশেষায়িত বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপনের কাজ শুরু হচ্ছে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে।
বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) সকালে চীন সরকারের ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল হাসপাতাল এলাকায় পরিদর্শনে এসে এ তথ্য জানান। চলতি মাসেই আনা হবে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র। দলটি এখান থেকে ফিরে গিয়ে নিজ সরকারের কাছে বার্ন ইউনিটের বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে; এরপরেই শুরু হবে কাজ।
প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ছিলেন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প এ বার্ন ইউনিট। কয়েকদিন আগেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এটা নিয়ে কথা হয়েছে। আগামী সপ্তাহেও জরুরি মিটিং আছে। যত দ্রুত এ হাসপাতালের কাজ শুরু করা যায়। দুই থেকে তিন মাসের মতো লাগবে। এরমধ্যে তারা তাদের ইকুয়েপমেন্ট-ফার্নিচার এসব নিয়ে আসবে।"
তিনি আরও বলেন, "কাজ শুরুর ২২ মাসের মধ্যে হাসপাতাল তৈরি হবে। আশা করছি দেড় বছরের মধ্যে ভালো কিছু হবে। চুক্তির ২২ মাসের মধ্যে হাসপাতাল তৈরির কাজ শেষ হলে সেই হিসাবে ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু করা যাবে।"
প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুসারে, প্রকল্পের জন্য ১১৮ মিলিয়ন ইউয়ান চীনের অর্থায়ন এবং প্রায় ৫১ কোটি ২২ লাখ টাকা সরকারি অর্থায়ন ব্যয় ধরে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া, প্রস্তাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ৩,৫০০ বর্গমিটার জমিতে অগ্নিদগ্ধদের জন্য উন্নত চিকিৎসা সুবিধাসহ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ১৫০ শয্যার ইউনিট তৈরিতে ১,০৬৫ জনবলের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
ডিপিপিতে হাসপাতালের নকশা, যন্ত্রপাতির, ফার্নিচার, যানবাহন, প্রয়োজনীয় ওষুধ, স্টেশনারি, প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত জনবলসহ ১৯টি বিষয়ের তালিকা প্রেরণ করা হয়। এরমধ্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ফার্নিচার চীন থেকে আনা হবে। পুরো প্রকল্পটি চীনের অর্থায়নে হবে। তবে প্রস্তাবিত জমির উন্নয়ন, সীমানা দেওয়াল, ড্রেনেজ সিস্টেম ও সড়ক উন্নয়নের জন্য ৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা; নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মীদের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং চীন থেকে আসা যন্ত্রপাতিসহ জিসিপত্রের জন্য ৪০ কোটি টাকা কাস্টমস ব্যয় সরকার বহন করবে।
জনবলের তালিকায় ২ জন চিফ কনসালটেন্ট, ১০ জন সিনিয়র কনসালটেন্ট, ৮৭ জন কনসালটেন্ট, ১ জন সহকারী পরিচালক, ৪ জন আবাসিক সার্জন, ৯ জন রেজিস্ট্রার, ১৮ জন সহকারী রেজিস্ট্রার, ১১০ জন সহকারী সার্জন, ৩১০ জন নার্স, ৪ জন দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা, ৯২ জন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ও ৪১৮ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রয়েছে।
৬তলা ইউনিট ভবনের নিচতলায় থাকবে জরুরি ও বহির্বিভাগ। দ্বিতীয় তলায় থাকবে ২৫টি আইসিইউ বেড। তৃতীয় তলার পুরোটাতেই থাকবে ২৫টি এইচডিইউ বেড। চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় থাকবে সাধারণ ওয়ার্ড এবং ষষ্ঠ তলায় ওয়ার্ডের সঙ্গে থাকবে অফিস। এছাড়া, ইউনিটকে ঘিরে তৈরি তিনটি সড়ক তৈরি করা হবে।
চমেক হাসপাতালের ২৬ শয্যার বার্ন ইউনিটে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম বিভাগের ৯টি জেলার প্রায় ৪ কোটি মানুষ নির্ভর করেন। ফলে রোগীর চাপ থাকে অনেক বেশি। ২৬ শয্যার ইউনিটে প্রতিদিন ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া, জরুরি বিভাগে ২৫-৩০ জন এবং আউটডোরে ৩০-৪০ জন রোগী চিকিৎসা নেন প্রতিদিন। ১৯৫৭ সালের অপারেশন থিয়েটার দিয়েই চলছে হাসপাতাল; নেই কোনো আইসিইউ; রয়েছে শয্যা সংকটও। হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে থাকেন অনেক রোগী। ইনফেকশন কন্ট্রোলের কোনো ব্যবস্থাও নেই।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, "অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইনফেকশন কন্ট্রোল (সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ)। কিন্তু এখানে একটি সাধারণ ওয়ার্ডে যথাযথ প্রটোকল মেনে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রোগীর চাপে পুরোপুরি সুস্থ্য না হয়েই অনেক রোগীকে হাসপাতাল ছাড়তে হয়। পরে আবার ইনফেকশন হয়। নতুন ইউনিটে অত্যাধুনিক চিকিৎসা সেবা পারেন রোগীরা।"
বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এলাকায় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সম্ভাব্য জমি পরিদর্শনে আসে চীন সরকারের একটি প্রতিনিধি দল। ওই সময় চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পেছনের খালি জমি নির্ধারণ করা হয়।
২০১৮ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশস্থ চীনা দূতাবাস বিশেষায়িত ১০০ শয্যার স্বয়ংসম্পূর্ণ বার্ন ইউনিট তৈরি করার আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রায় চার হাজার বর্গফুট জমিতে চারতলা বিশিষ্ট ১০০ শয্যার বিশেষায়িত ইউনিট নির্মাণের নকশা তৈরি করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত স্থানে প্রয়োজনের তুলনায় কম জমি থাকায় সৃষ্টি হয় জটিলতা। পরে ২০২০ সালের জুলাইয়ে চীন সরকারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে 'বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ বার্ন হাসপাতাল' নির্মাণের বিষয়ে আবারও প্রস্তাব দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত। এর ভিত্তিতে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সম্ভাব্য চারটি স্থানের প্রস্তাবনা দেয়।
২০২২ বছরের জুনে সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খান চিকিৎসকেরা। তখন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বার্ন ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের বিষয়ে শুরু হয় জোরালো আলোচনা। পরে চলতি বছর চমেক হাসপাতালের প্রধান ছাত্রাবাসের উত্তর পাশের (গোয়াছি বাগান নামে পরিচিত) জমিটিকে বার্ন ইউনিট নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত করা হয়।