দাম বাড়ানোর পর ওয়াসার এটিএম বুথ থেকে পানি কেনা কমে গেছে
রাজধানীর দিলুরোড এলাকার বাসিন্দা মো. হামিদের পরিবারে প্রতিদিন ২০ লিটারের মতো খাবার পানির দরকার হয়। যা তিনি গত ২ মাস আগে নিয়মিত ওয়াসার পানির বুথ থেকেই ৪০ পয়সা/লিটার দরে কিনে নিতেন। কিন্তু গত ১ আগস্ট থেকে এ পানির দাম এক ধাপে দ্বিগুণ করার পরে নিয়মিত আর বুথ থেকে পানি কিনেন না। বাসায় গ্যাসের চুলায় পানি ফুটিয়েই পান করেন।
হামিদ সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যার্ডকে বলেন, 'আগে প্রতিদিন ২০ লিটার পানি কিনতাম, আর এখন সপ্তাহে ২০ লিটারও কিনি না। হুট করে পানির দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্যাসের চুলায় পানি ফুটিয়েই পান করি।'
দিলু রোডের পানির বুথের অপারেটর ফাহাদ টিবিএসকে বলেন, 'পানির দাম বেড়ে যাওয়ার আগে এ বুথ থেকে প্রতিদিন ১৪ হাজার লিটারের মতো পানি বিক্রি হতো, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার লিটারে। এ পাম্পে নিবন্ধিত প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ গ্রাহক আছেন। হুট করে পানির দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় এ প্রভাব পড়েছে।'
রাজধানীবাসীর জন্য স্বল্প মূল্যে খাবার পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ড্রিংকওয়েল- এর সাথে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে এটিএম বুথের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করে আসছে ঢাকা ওয়াসা। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এ বুথের গ্রাহক ক্রমান্বয়ে বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু গত ১ আগস্ট থেকে বুথে পানির দাম ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮০ পয়সা করায় বিক্রি কমে গেছে প্রায় ১৫ শতাংশ।
তবে গ্রাহকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের এ চড়া বাজারে অতি-প্রয়োজনীয় পানির মূল্য ১০০% বৃদ্ধি অযৌক্তিক। একদিকে নগরবাসীর জন্য সুপেয় পানি লাইনে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে ঢাকা ওয়াসা; আবার কিনে খাওয়া পানিরও দাম বাড়িয়েও জনসাধারণের খরচের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ড্রিংকওয়েল এর কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা ওয়াসার সহায়তায় তারা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৩০ স্থানে পানির এটিএম বুথ স্থাপন করেছেন। বর্তমানে এসব বুথের মধ্যে ৯০টি বন্ধ রয়েছে।
রাজধানীর মিরপুর, আগারগাঁও, শ্যাওড়াপাড়া, বাসাবো, ফকিরাপুল, আজিমপুর, মোহাম্মদপুর, কমলাপুর, গাবতলী, উত্তরা, দয়াগঞ্জ, বাড্ডা, ভাটারা, বসুন্ধরা, মহাখালী, মগবাজার-সহ বিভিন্ন এলাকায় এরমধ্যে ২৪২টি বুথ সচল আছে। ঢাকায় তাদের নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ৪ লাখের বেশি। দৈনিক পানি বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৪.৫ লাখ লিটার, এখন গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে, তবুও পানির দাম বাড়ানোর পর বিক্রি কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। বর্তমানে দৈনিক পানি বিক্রির পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ লিটার।
ঢাকা ওয়াসা পাইপের মাধ্যমে শহরের বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহ করে। কিন্তু, পাইপে ছিদ্র থাকায় পানিতে ময়লা-যুক্ত হয়, ফলে অনেকেই এ পানি খাওয়াকে নিরাপদ মনে করেন না। এমনকী অনেক নগরবাসী ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে গোছল করাও এড়িয়ে চলেন। ফোটানো ছাড়া এ পানি পান করেন না।
@ বেশি প্রভাবিত নিম্ন-আয়ের মানুষ
রাজধানী মধুবাগের একজন বাসিন্দা হুমায়ূন কবির টিবিএসকে বলেন, 'আমরা আগে পানি ফুটিয়েই পান করতাম, কিন্তু তাতে খরচ বেশি, আবার পানিতেও বাজে গন্ধ থাকে। ড্রিংকওয়েল পানির বুথ স্থাপনের পর থেকে, আমরা সেখান থেকেই কেনা শুরু করি। মাসিক খরচ মাত্র ১৫০ টাকা। তারপরও আমাদের জন্য সেটা বেশি, তাই আগের চেয়ে কম কিনছি। আগে দিনে ১৫ লিটার পানি ব্যবহার হতো আমার পরিবারে, এখন সেটা ১০ লিটারে নামিয়ে এনেছি। আমরা নিম্ন-আয়ের মানুষ আমাদের সবকিছুতেই টানাটানি, সবকিছুই আমাদের কমাতে হয়, এমনকি পানিও।'
ওয়াটার পানির এটিএম বুথ প্রকল্পের পরিচলক ও ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী রামেশ্বর দাস বলেন, 'ড্রিংকওয়েল আমাদের বুথগুলো স্থাপনসহ পানি পরিশোধনের খরচ, বুথের কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে। এরপরেও এসব বুথগুলো মেনটেন করতে আমাদের বিদ্যুৎ খরচ এবং প্রতি মাসে একটি বিল দিতে হয়। তারপরেও আমাদের বিদ্যুৎ বিল ও এসব বুথ পরিচালনার মাসিক বিল মেটাতে হয়। পানির দাম বাড়ানোর আগে আমাদের প্রতি লিটার পানিতে প্রায় ৩০ পয়সা ভর্তুকি দিতে হতো। তাই ভর্তুকি কমিয়ে আনতেই দাম বাড়িয়ে ৮০ পয়সা করা হয়েছে। যেখানে ১০ পয়সা যাবে সরকারি রাজস্বে। দাম বাড়ানোর পরে ওয়াটার বুথে ঢাকা ওয়াসার ব্যয় ও আয়ে সামঞ্জস্য নিশ্চিত হয়েছে।'
তিনি বলেন, আগে পানির দাম কম থাকায় অনেকেই এ পানি পান ব্যতিত অন্য কাজেও ব্যবহার করতো। তাই ওয়াসার ভর্তুকি কমাতে ও পানির অপচয় রোধে– বিভিন্ন পণ্যের দাম বিবেচনায় পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।
তিনি জানান, শুরুতে নগরীর নিম্ন-আয়ের মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ড্রিংকওয়েল এর এটিএম বুথ স্থাপন করা হয়। কিন্তু, এখন প্রায় সব শ্রেণির মানুষই বুথ থেকে পানি কিনছে।
ঢাকায় এ প্রকল্পের আওতায় পানির ৫০০ এটিএম বুথ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে ঢাকা ওয়াসা ও ড্রিংকওয়েলের। রাজশাহী ও চট্টগ্রামেও তারা কিছু বুথ স্থাপন করেছে।
ড্রিংকওয়েলের কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন রনি বলেন, স্বল্পমূল্যে দরিদ্র নগরবাসীকে নিরাপদ পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে ঢাকার মুগদা এলাকায় প্রথম পানির বুথ স্থাপন করা হয়। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্প চালিয়ে যেতে ড্রিংকওয়েল ইউএসএ'র সাথে একটি চুক্তি করেছে ঢাকা ওয়াসা।
তিনি আরও বলেন, 'কেবল ঢাকায় নয়, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতেও আমরা ওয়াটার এটিএম স্থাপন করেছি। চট্টগ্রামে পানির দাম (লিটারে) ৮০ পয়সা এবং রাজশাহীতে ৬০ পয়সা। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আরও ৫০টি এটিএম বুথ স্থাপনের পরিকল্পনা আছে, আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা এগুলো চালু করতে চাই।'
ওয়াসার পানির বুথে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও পাসপোর্ট সাইজের দুই কপি ছবি দিয়ে ৫০ টাকায় নিবন্ধন করে এটিএম কার্ড নিতে পারেন গ্রাহকরা। বুথ অপারেটর বা মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতাদের মাধ্যমে কার্ডে ১০ টাকা থেকে ৯৯৯ টাকা পর্যন্ত রিজার্জ করা যায়।