গ্যাসের চাপ কম, নিষ্ক্রিয় পড়ে আছে ১,৪৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা দুই কম্প্রেসার স্টেশন
জাতীয় সঞ্চালন লাইনে গ্যাসের চাপ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে এ লাইনে গ্যাসের প্রবাহ বাড়াতে আশুগঞ্জ ও এলেঙ্গায় স্থাপিত দুটি কম্প্রেসার স্টেশন নিষ্ক্রিয় পড়ে আছে।
১,৪৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত দুটি স্টেশনের এ অবস্থার কারণে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা, বগুড়া এবং সিরাজগঞ্জসহ নিম্নাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের আরও অবনতি ঘটছে।
আশুগঞ্জ স্টেশনটি ২০২১ সাল থেকে নিষ্ক্রিয় পড়ে আছে। অন্যদিকে এলেঙ্গা স্টেশনে কখনোই কাজ হয়নি।
সাম্প্রতিক একটি বৈঠকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এই বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। স্টেশনের অপারেটর গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডকে (জিটিসিএল) কম্প্রেসার ইউনিটগুলো সক্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
জিটিসিএল বলছে, ট্রান্সমিশন পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ বাড়লে স্থানীয় ক্ষেত্র থেকে বাড়তি গ্যাস উৎপাদন বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি বাড়িয়ে ইউনিটগুলো সক্রিয় করা যেতে পারে।
জিটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রুখসানা নাজমা ইছহাক জানান, আশুগঞ্জ স্টেশনটি ২০১৮ সালে স্থাপনের পর প্রথম তিন বছর বেশ ভাল কাজ করেছে।
কিন্তু ২০২১ সাল থেকে চলমান ডলার সংকটের ফলে গ্যাস সংকট দেখা দেওয়ায় এটি নিষ্ক্রিয় পড়ে আছে।
তিনি বলেন, "এলএনজি প্রাপ্যতা না বাড়লে এই স্টেশন পুনরায় সচল করা চ্যালেঞ্জিং হবে।"
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম তামিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পাইপলাইনে গ্যাসের সহজলভ্যতা নিশ্চিত না করে এ ধরনের প্রকল্প নির্মাণ করা জনগণের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
গ্যাসের উৎস ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত না করে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, "গ্যাস উৎপাদন ও আমদানি বাড়ানোর জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এই স্টেশনগুলো চালু করতে হবে।"
এদিকে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান টিবিএসকে বলেন, এই কম্প্রেসারগুলো একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে স্থাপন করা হয়েছিল। শিল্প ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্রমাগত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে স্থাপিত হয়েছিল এগুলো।
"বর্তমানে যে সমস্যাটা হচ্ছে তা মূলত ডলার সংকটের কারণেই। আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে আমাদের বকেয়া আছে। আবার কম্প্রেসার স্টেশন চালানোর জন্য যে এলএনজি প্রয়োজন সেটিও উচ্চ মূল্যের কারণে স্পট মার্কেট থেকে কেনা চ্যালেঞ্জিং," বলেন তিনি।
কামরুজ্জামান খান বলেন, ডলার সংকটের সমাধান হলে স্টেশনগুলো চালু হবে।
কেন কম্প্রেসার স্টেশন প্রয়োজন
সঞ্চালন লাইনের সর্বশেষ গ্রাহক পর্যন্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিতে ব্যবহার করা হয় কম্প্রেসার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং হবিগঞ্জের ক্ষেত্র থেকে উত্তোলনকৃত গ্যাসের চাপ প্রাথমিকভাবে ১০০০ পিএসআই হলেও, দূরত্ব বাড়তে থাকলে এ চাপ কমতে থাকে। সঞ্চালন লাইনের অন্তর্নিহিত রেজিস্টেন্সের কারণে এমনটি হয়।
চাপ কমতে থাকলে সঞ্চালন লাইনের প্রান্তে থাকা গ্রাহকের কাছে গ্যাস সরবরাহ করাটা ট্রান্সমিশন কোম্পানির জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।
২০১৩ সালে আশুগঞ্জ পয়েন্টে গ্যাসের চাপ ছিল ৭০০ পিএসআই। যা গাজীপুর, ময়মনসিংহ, সাভার, টঙ্গী এবং ঢাকার প্রান্তে থাকা গ্রাহকদের কাছে গ্যাস সরবরাহের জন্য ছিল অপর্যাপ্ত।
সর্বশেষ গ্রাহক পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর জন্য ২০০৬ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় জিটিসিএল। ২০১৩ সালে অনুমোদনের পর প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুন মাসে বাস্তবায়িত হয়।
কম্প্রেসার স্টেশন চালু হয়ে গেলে গ্যাসের চাপ ১০০০ পিএসআইতে উঠবে- এই প্রত্যাশায় পাঁচটি কম্প্রেসার ইউনিট স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে তিনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ পয়েন্টে এবং দুটি টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পয়েন্টে।
আশা করা হয়েছিল, সঞ্চালন লাইনে এলএনজির পরিমাণ ৯০০ এমএমসিএফডি ছাড়িয়ে গেলে আশুগঞ্জ স্টেশনটি চট্টগ্রাম বিভাগের পর ঢাকা, রাজশাহী এবং বগুড়ায়ও গ্যাস সরবরাহ করবে।
কিন্তু প্রত্যাশিত মাত্রায় গ্যাসের চাপ আর বাড়েনি। ২০১৮ সালে ব্যয়বহুল এই কম্প্রেসার স্টেশন চালুর পর থেকে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে এলএনজি'র পরিমাণ খুব কম সময়ের জন্যই ৯০০ এমএমসিএফডি-তে উঠেছে।
গ্যাস সরবরাহের বর্তমান চিত্র
বৈঠকের নথি অনুসারে, আশুগঞ্জে বর্তমানে ইনলেট প্রেসার [সাকশন পাইপ যেখানে বুস্টার পাম্পের সাথে মিলিত হয়, সে অংশের চাপ] মাত্র ৬৮০ পিএসআই এবং এলেঙ্গায় ৬৫০ পিএসআই।
জাতীয় গ্যাস ট্রান্সমিশন গ্রিডে মোট গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ২,৫৯৯.৭ এমএমসিএফ; এরমধ্যে ৪৯৮এমএমসিএফ আসে এলএনজি থেকে।
পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদনের তথ্য থেকে জানা যায়, জাতীয় গ্যাস লাইনে সর্বাধিক গ্যাস ইনপুট ছিল এ বছরের মাঝামাঝিতে, প্রায় ৩,১০০ এমএমসিএফ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় জাতীয় গ্রিডে মোট গ্যাসের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, যা বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করেও পুনরুদ্ধার করা যাচ্ছে না।