চার ইউরিয়া কারখানাই চালু হওয়ায় বোরো মৌসুম নিয়ে উদ্বেগ কেটেছে
ডিসেম্বরে শুরু হবে বোরো মৌসুম। তার আগেই ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে গ্যাস সংকটে পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাওয়া তিনটি সরকারি মালিকানাধীন ইউরিয়া সার কারখানা ফের চালু হওয়ায় ইউরিয়া সংকটের আশঙ্কা আর থাকছে না।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যসের চাহিদা কমেছে। এ কারণে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।
এছাড়া বোরো মৌসুমে দেশে যাতে কোনোভাবেই ইউরিয়া সারের সংকট তৈরি না হয়, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে দেশে বর্তমানে চারটি ইউরিয়া উৎপাদনকারী সার কারখানা রয়েছে— শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড, চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড, যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড এবং আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড।
গ্যাসের সংকটের কারণে চার কারখানার তিনটিই—যমুনা, চিটাগাং ও আশুগঞ্জ—এতদিন বন্ধ ছিল।
বিসিআইসি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গ্যাস পাওয়ায় এখন আমাদের চারটি কারখানাই চালু করা হয়েছে। এটা বোরো মৌসুমে ইউরিয়ার সরবরাহ নিরাপদ করতে ভূমিকা রাখবে।
'যখন কারখানা বন্ধ ছিল, তখন আমরা বিকল্প হিসেবে অতিরিক্ত ইউরিয়া আমদানির পরিকল্পনা করেছিলাম।'
তিনি জানান, আমদানির ওপর বাড়তি চাপ এখন কমবে।
বিসিআইসির তথ্যানুসারে, কর্পোরেশনের চারটি কারখানা টানা চালাতে প্রতিদিন অন্তত ১৮৯ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাসের প্রয়োজন হয়।
২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পেট্রোবাংলা সার কারখানাগুলোতে ২৫০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ করে আসছিল। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে ২০২২ সালের জুন থেকে সরবরাহের পরিমাণ দৈনিক ১৩০ এমএমসিএফে নেমে আসে। সে কারণে বিসিআইসি ধীরে ধীরে তাদের কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
২০২২ সালের নভেম্বরে চিটাগাং-এর কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, এরপর চলতি বছরের এপ্রিলে বন্ধ হয়ে যায় আশুগঞ্জ কারখানা। তারপর সেপ্টেম্বরে বন্ধ হয় যমুনা সারখানা—এ কারখনায় সরবরাহ করা গ্যাস দেওয়া হয় নরসিংদীতে নবনির্মিত ঘোড়াশাল-পলাশ কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য।
তিন ইউরিয়া কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিসিআইসির চলতি অর্থবছরের ১০ লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে।
বাংলাদেশে বার্ষিক ইউরিয়ার চাহিদা ২৬-২৭ লাখ টন। স্থানীয় কারখানাগুলো এখন প্রায় ১০ লক্ষ টন ইউরিয়া উৎপাদন করে, বাকি চাহিদা মেটাতে হয় আমদানির মাধ্যমে।
তবে ১২ নভেম্বর উদ্বোধন হওয়া ঘোড়াশাল-পলাশ কারখানা দেশের সার আমদানিনির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারখানাটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৯.২৪ লাখ টন ইউরিয়া।
ঘোড়াশাল পলাশ কারখনায় এখনও পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলছে। তাই আসন্ন বোরো মৌসুমের জন্য প্রায় ১৩ লাখ টন ইউরিয়ার চাহিদা মেটাতে বন্ধ থাকা কারখানাগুলো ফের চালু করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে বিসিআইসিকে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর যমুনা কারখানা বন্ধ হওয়ার পর বিসিআইসি শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয়। তাতে পরিস্থিতি তুলে ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোতে ফের কাজ শুরু করার সুবিধার্থে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের অনুরোধ করা হয়।
চিঠিতে বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে অন্তত দুটি কারখানা জরুরি ভিত্তিতে ফের চালু করতে না পারলে ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া বোরো মৌসুমে ইউরিয়া সারের সরবরাহ সংকটের আশঙ্কার কথা জানায় বিসিআইসি।
বোরো মৌসুমের পিক সিজন ধরা হয় ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। এ মৌসুমে ২ কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়, যা দেশের সারা বছরের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
হরতাল, অবরোধে বিঘ্নিত ইউরিয়া সরবরাহ
এদিকে সবগুলো সার কারখানা ফের চালু করায় ইউরিয়ার উৎপাদন নিয়ে তাৎক্ষণিক সংকট কাটলেও নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে।
বিরোধী দলগুলোর ডাকা টানা হরতাল-অবরোধে সারা দেশেই সার সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। সীমিত ট্রাক চলাচলের কারণে সারা দেশের গুদামগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এতে বোরো মৌসুমের পিক সিজনে চাহিদা অনুযায়ী দেশজুড়ে সার সরবরাহ করা নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পরিবহন ঠিকাদাররা বলছেন, বোরো মৌসুমে সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৮-২০ হাজার টন সার বিভিন্ন গুদামে প্রবেশ করে। এ সময় প্রতিদিন ৯০০ থেকে ১ হাজার ট্রাক প্রয়োজন হয়।
কিন্তু চলমান অবরোধের কারণে সার পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না। ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক চালাতে চাইছেন না পরিবহন মালিকরা। এতে ব্যাহত হচ্ছে সার সরবরাহ।
এর ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়ে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে করছে বিসিআইসি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয় ও সারা দেশে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের (ডিসি-এসপি) আলাদা আলাদা চিঠি দিয়ে পরিবহন সমস্যার কথা জানিয়েছে বিসিআইসি।
এসব চিঠিতে হরতাল-অবরোধে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।