সারের সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির উদ্বেগ নিয়ে শুরু হচ্ছে বোরো মৌসুম
দেশের চাল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মৌসুম বোরোর আবাদ শুরু হয়েছে। কিন্তু এ সময়ই সরবরাহ সংকটে সারের দাম গেছে বেড়ে।
ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহ থেকে পুরোদমে ধান আবাদ করবেন কৃষকরা। এ মৌসুমে সবচেয়ে বেশি সারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারনির্ধারিত দামের চেয়েও ৩-৮ টাকা বেশি দামে প্রতি কেজি সার কিনতে হচ্ছে কৃষককে।
সরকারিভাবে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া ও টিএসপির নির্ধারিত মূল্য ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা এবং এমওপি ২০ টাকা।
তবে বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া ২৮-৩২ টাকা, টিএসপি ৩০-৩৫ টাকা, ডিএস্পি ২৫-৩৫ টাকা এবং এমওপি ২৫-৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে কৃষকদের।
কৃষকরা বলছেন, ডিলাররা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। অন্যদিকে ডিলাররা বলছেন, সারের সরবরাহ আগের চেয়ে কম থাকায় তারা বেশি দামে বিক্রি করছেন।
লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী ও নওগাঁর মতো কিছু জেলায় ইঙ্গিত দেয় কিছু ডিলার ক্যাশ মেমো দিয়ে সার বিক্রি করছেন না।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মিরিকপুর এলাকার কৃষক মো. মানিক স্থানীয় বাজার থেকে সার কিনেন। চলতি সপ্তাহে ইউরিয়া প্রতি কেজি ৩০ টাকা, এমওপি ২৫ টাকা, টিএসপি ও ডিএপি ৩৫ টাকা করে কিনেছেন বলে জানান তিনি। 'সারের ক্যাশ মেমো দেয় না বিক্রেতারা। সরকারি দামে সার কিনতে পারি না। কেজিতে ৫-১০ টাকা বেশি দিতে হয়,' টিবিএসকে বলেন মানিক।
একই উপজেলার সার বিক্রেতা আবদুল মাজেদ বলেন, সারের বেশি দাম হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে প্রয়োজন অনুসারে সার পাওয়া যাচ্ছে না। 'সে কারণে বড় বড় ডিলাররা সংকট দেখিয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করে।'
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) গুদাম থেকে সার বের হয়ে ডিলার ও সাব-ডিলারদের কাছে যায়। ডিলার ও সাব-ডিলারদের কাছে থাকা সারের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
১৬ জানুয়ারির হালনাগাদকৃত তথ্যে দেখা যায়, ডিলার পর্যায়ে ইউরিয়ার মজুত রয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে মজুত ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার টন।
তবে গত বছরের তুলনায় টিএসপির মজুত ২১ শতাংশ, ডিএপি ৩৪ শতাংশ এবং এমওপির মজুত ১৯ শতাংশ কম রয়েছে। বর্তমানে টিএসপি ৪৫ হাজার টন, ডিএপি ৮৩ হাজার টন এবং এমওপির মজুত রয়েছে ৬০ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে টিএসপি ৫৭ হাজার টন, ডিএপি ১ লাখ ২৬ হাজার টন এবং এমওপির মজুত ছিল ৭৪ হাজার টন।
কৃষি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, লক্ষ্মীপুর জেলায় ইউরিয়া ছাড়া চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত সারের সরবরাহ নেই।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক সোহেল মো. শামছুদ্দিন ফিরোজ বলেন, 'বর্তমানে বাজারে ইউরিয়া সারের সংকট নেই। কিন্ত নন-ইউরিয়া সারের কিছু ঘাটতি রয়েছে। সেটা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পূর্ণ হবে।'
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে চাহিদা অনুযায়ী ইউরিয়া পাওয়া গেলেও এ পর্যন্ত ডিএপি ২ হাজার ৪০০ টনের বিপরীতে ৫৩৭ টন, এমওপি ২ হাজার ৭৭০ টনের বিপরীতে ১ হাজার ২৯৭ টন এবং টিএসপি ৩ হাজার ৪৮০ টনের বিপরীতে ১ হাজার ১৫৯ টন পাওয়া গেছে।
লক্ষীপুরের মতো অন্যান্য জেলার চিত্রও একই।
রাজশাহীর পবার খোলাবোনা বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া ২৮ টাকা, টিএসপি ৩৪ টাকা, ডিএপি ৩০-৩২ টাকা এবং এমওপি ২৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজশাহীর দুর্গাপুরের কৃষক রাশেদুল্লাহ বলেন, 'সার কিনতে গেলে বলা হয়, সার নাই। কিন্তু দাম বেশি দিলে তখন সার দেয়। তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রেখেছে।'
নওগাঁর পশ্চিম দুর্গাপুরের কৃষক হাবিবুর রহমান ১৫ শতক জমিতে বোরোর আবাদ করবেন। টিবিএসকে তিনি বলেন, 'ইউরিয়া এখন ৩২ টাকা কেজি। সবসময় দেখি ইউরিয়ার দাম কম থাকে, কিন্তু এখন বেশি। ডিএপি ও এমওপি ৫-৬ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ডিলারদের জিজ্ঞেস করলে বলে, সারের সংকট রয়েছে।'
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় প্রতি কেজি টিএসপি ৩০-৩৫ টাকা, ইউরিয়া ৩০-৩২ টাকা, এমওপি ২৫-৩০ টাকা ও ডিএপি ২৫-৩০ টাকায় কিনছেন কৃষকরা।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ টিবিএসকে বলেন, 'বর্তমান সার সংকটের একটি কারণ হলো আগের বছরের তুলনায় আলু ও পেঁয়াজের চাষ বৃদ্ধি। এই ফসলগুলোতে বেশি সার লাগে, যা মজুতের ওপর কিছুটা চাপ তৈরি করতে পারে। সরকারের উচিত পরিবর্তিত পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে চাহিদা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার জন্য একটি পূর্বাভাস শাখা চালু করা।'
সারের মোট মজুত কত?
ইউরিয়া সারের জোগান আসে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিআইসির স্থানীয় উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে।
আর নন-ইউরিয়া সারের—টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—জোগান দিয়ে থাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিএডিসি। এর পাশাপাশি নন-ইউরিয়া সারের একটা যোগান আসে বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, নিরাপত্তা মজুত হিসেবে ইউরিয়া ৫ লাখ টন, ডিএপি ৩ লাখ টন এবং টিএসপি ও এমওপি ২ লাখ টন করে রাখতে হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া নন-ইউরিয়া ও ইউরিয়া সারের মজুতের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৬ জানুরি পর্যন্ত নিরাপত্তা মজুদসহ ইউরিয়ার মজুত রয়েছে ৭.৯৪ লাখ টন। এছাড়া টিএসপি ১.০৭ লাখ টন, ডিএপি ১ লাখ টন এবং এমওপি ২.৯৭ হাজার টন মজুদ রয়েছে। অর্থাৎ টিএসপি ও ডিএপি নিরাপত্তা মজুতের চেয়েও কম রয়েছে।
দেশে ইউরিয়ার বার্ষিক চাহিদা ২৭ লাখ টন, টিএসপি ৭.৫ লাখ টন, ডিএপি ১৫ লাখ টন এবং এমওপি ৯.৫০ লাখ টন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে জানুয়ারি ও ফ্রেব্রুয়ারি মাসে। কারণ বোরো ধান, আলু ও পেঁয়াজসহ রবি মৌসুমের অধিকাংশ ফসলে এ দুই মাসে সারের প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, জানুয়ারি মাসে ইউরিয়া ৪.১৯ লাখ টন, টিএসপি ১.১৫ লাখ টন, ডিএপি ২.৬৮ লাখ টন এবং এমওপির ১.৪৫ লাখ টন চাহিদা রয়েছে। আর ফেব্রুয়ারি মাসে চাহিদা রয়েছে ইউরিয়া ৪.৩৯ লাখ টন, টিএসপি ৮০ হাজার টন, ডিএপি ১.৪৪ লাখ টন এবং এমওপি ৬৫ হাজার টন।
সরবরাহ সংকট কি আরও তীব্র হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকবে। এ পর্যন্ত সারের পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিতের পাশাপাশি সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার তাগিদ দেন তারা।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক টিবিএসকে বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার সার ব্যবস্থাপনা মসৃণ করতে পারছে না। ডিলার পর্যায়ে সারের সংকট রয়েছে।
'সামনে বোরো মৌসুম। সবচেয়ে বেশি সার তখন প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখনও কৃষককে বাড়তি দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। গত সরকারের শেষ ছয় মাসে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারায় সার আমদানি সমস্যা হয়েছিল। এর প্রভাব এখনও রয়েছে। সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে। কৃষকরা যেন সহজভাবে সার পান, তা নিশ্চিত করতে হবে।'
তবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারের কোনো সংকট হবে না জানিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত যে মজুত আছে, তা দিয়ে ফেব্রুয়ারি পর্যন্দ সুন্দরভাবে চলে যাবে। সার পাইপলাইনে আছে। এটা নিয়মিত আসছে এবং ব্যবহার করছে। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সারে কোনো সমস্যা হবে না।'
অতিরিক্ত দামের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রম চলছে। এর বাইরেও কেউ ঢালাওভাবে না বলে যদি স্পেসিফিক অভিযোগ করেন, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব। কিছু লিমিটেশন থাকে, যেমন পরিবহনে কিছুটা দেরি হয় জ্যাম বা অন্য সমস্যার কারণে। আবার কোনো ডিলারের চাহিদা ২৫ বস্তা, তিনি ৫০ বস্তা নিয়ে যাচ্ছেন। এতে অন্যদের জন্য সংকট তৈরি হচ্ছে। কিছু বাস্তবতা তো আছে। তবে এগুলো আমরা কাটিয়ে উঠছি। '