বেড়েছে কৃষি ঋণের সুদহার, দাম বাড়বে কৃষিপণ্যের
চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণে সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ার পর কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদহার প্রায় ১০% বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এর ফলে বাজারে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। দাম বাড়তে পারে কৃষিপণ্যের। সেইসাথে দাম বাড়তে পারে চাল, হাস-মুরগি ও গবাদি পশুরও।
এ খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণকারি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) চলতি নভেম্বরে কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদহার বাড়িয়ে ৯.৯৩% নির্ধারণ করেছে।
পাশাপাশি সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকও ৯.৯৩% সুদহার নির্ধারণ করেছে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) গত মাসে এ খাতে ৯.১০% সুদহার নির্ধারণ করেছে। এখন নতুন করে সুদহার বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে বিশেষায়িত ব্যাংকটি।
একইভাবে বেসরকারি ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কে বিতরণ করা ঋণের সুদহারও এখন ১০% এর কাছাকাছি। আর যেসব কৃষি ঋণ ব্যাংকগুলো এনজিওদের মাধ্যমে বিতরণ করে সেগুলোর সুদহার ১০ শতাংশেরও বেশি।
গত জুন পর্যন্ত কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদহার ছিল ৮% এর নিচে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী টিবিএসকে বলেন, "কৃষি ঋণের সুদহার বেড়ে গেলে উৎপাদন খরচ যেমন বাড়বে। তেমনি আবাদ কমে উৎপাদন কমে যাওয়ারও আশংকা রয়েছে।"
কৃষকরা বলছেন, কৃষি ঋণে উচ্চ সুদহারের অতিরিক্ত খরচ মেটাতে পণ্যের দাম বাড়াতে হবে, অন্যথায় তারা লোকসানের মুখে পড়বেন।
সুদহার বাড়ানোর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, ঋণ ও আমানত সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার পর বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
"যেকারণে ঋণের সুদহার বাড়াতে হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত ফর্মুলার মধ্যে থেকে সেটা করা হয়েছে," বলেন তিনি।
দাম বাড়বে কৃষিপণ্যের
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন সময়ে কৃষি ঋণের সুদহার বাড়ছে, যখন কৃষি খাতের অন্যান্য ব্যয়ও ঊর্ধ্বমুখী। সরকার সারের দাম বাড়িয়েছে। বেড়েছে শ্রম মজুরি। ডলার সংকটে টাকার মান কমে যাওয়ায় কীটনাশকের দামও গত বছরের তুলনায় এবছর বেশি। কৃষি ও পল্লী ঋণে সুদের হার বৃদ্ধি এ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে ফেলবে।
ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চলে বোরো মৌসুম। দেশে বার্ষিক যত ধান উৎপাদন হয় তার ৫৫% এর বেশি বোরো। বোরো মৌসুমে ২ কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়, যা দেশের সারা বছরের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভুমিকা রাখে।
সম্প্রতি চালের দাম বেড়েছে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ১৬ নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম ৪.০৮% বেড়েছে। যদিও ভোক্তারা বলছেন চালের দাম কেজিতে মান ও জাত ভেদে বেড়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা।
ব্যাংকগুলোর মৎস ও প্রাণী সম্পদ খাতে বিতরণ করা ঋণও কৃষি ও পল্লী ঋণের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ মাছ, মুরগি, ডিমের খামারিদের ঋণের পাশাপাশি গবাদি পশু পরিপালনের ঋণের সুদহারও বাড়ছে। এতে মাছ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন খরচও বাড়বে।
গত এক বছর ধরে মাছ, ডিম, মাংসের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। এ অবস্থায় ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় আগামীতে কৃষি, পোল্ট্রি, গবাদিপশু খাতের পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়বে।
বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার কৃষক ফোরকান মোল্লা বলেন, কৃষি ব্যাংকের দেওয়া কৃষি ঋণে ছয় থেকে নয় মাসের মধ্যে সুদসহ পুরোটা পরিশোধ করতে হয়।
"সুদের হার বাড়ানোয় এই অতিরিক্ত খরচ মেটাতে কৃষকদের পণ্যের দাম বাড়াতে হবে। তা না হলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে," বলেন তিনি।
একই উপজেলার আরেক কৃষক মিরাজ শেখ জানান, তিনি মাছ চাষের জন্য ঋণ নিয়েছিলেন; যা তিনি বছরে দুই থেকে তিন কিস্তিতে শোধ করতে পারেন। সুদহার বাড়ায় মাছের উৎপাদন খরচ বাড়বে ভেবে শঙ্কিত তিনি।
দিনাজপুরে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের একটি শাখার ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কৃষকরা সব সময়ই কম সুদে ঋণ নিতে চান। তিনি আরও বলেন, উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হলে কৃষকরা কিছুটা হতাশ হবেন।
ঋণের সুদহারে সীমা তুলে নেওয়ার প্রভাব
এ বছরের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নেয়। এরপর সুদহার নির্ধারণের নতুন নিয়ম চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিয়মটি হলো, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের শেষ ৬ মাসের সুদহারের গড়কে ভিত্তি ধরে তার সাথে একটি মার্জিন যোগ করে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার বা সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট ট্রেজারি বিল (স্মার্ট) প্রকাশ করে।
শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, ব্যাংকগুলো স্মার্ট- এর সাথে ৩% মার্জিন যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করবে। আর কৃষি ঋণের সুদহার হবে স্মার্ট- এর সাথে ২% যোগ করে।
এরপর গত অক্টোবরে আরেক সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ব্যাংকগুলো বাণিজ্যিক ঋণে স্মার্ট- এর সাথে ৩.৫% আর কৃষি ঋণের স্মার্ট- এর সাথে ২.৪% মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে।
চলতি নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক স্মার্ট রেট জানিয়েছে ৭.৪৩%। সরকার ট্রেজারি বিল থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার কারণে এর সুদহারও বেড়েছে। এর সাথে ২.৫ শতাংশ যোগ করে সর্বোচ্চ সুদহারই নির্ধারণ করেছে কৃষি ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক।
এ নিয়ে গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক তিন দফা ঋণের সুদহার পরিবর্তন করলো। প্রতিবারই বেড়েছে সুদহার। যা গত অক্টোবরে ছিল ৯.৭০%। আর অর্থবছরের শুরুতে ৫ জুলাই এই সুদহার ছিল ৯.১০%।
মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, সীমা তুলে দেওয়ার পরে সুদহার বাড়ছে। তবে সুদহার যত না চাহিদার কারণে বাড়ছে তার চেয়ে বেশি বাড়ছে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে।
"অব্যবস্থাপনা, অনিয়মের কারণে অনেক ব্যাংকে উচ্চ খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। পরিচালন ব্যয়ও অনেক বেশি। ঋণের সুদহার বাড়িয়ে ব্যাংকগুলো এখন এই অযাচিত ব্যয় তোলার চেষ্টা করছে। এক কথায় ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা, দুর্বলতার দায় গ্রাহকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে," বলেন তিনি।
কৃষি ঋণ বিতরণ
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে কৃষি ব্যাংককে ৬,৮০০ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে।
আর চলতি অর্থবছরে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১,৯২০ কোটি টাকা। এছাড়া সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক ৩২৮০ কোটি টাকা বিতরণ করবে।
বাকি ঋণ বিতরণ করা হবে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এবং এনজিও লিংকেজে।
এর আগের অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলো ৩২,৮৩০ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করেছে। ওই অর্থবছরে ৩৬ লাখ কৃষক ঋণ পেয়েছেন।
আমদানি-বিকল্প ফসল চাষ উৎসাহিত করতে সরকারের সুদ ভর্তুকির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। আবার কৃষি খাতে অর্থায়ন উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল রয়েছে। এসব ঋণে কৃষক পর্যায়ে সুদহার ৪ থেকে ৫ শতাংশ।
কম সুদের এই ঋণের মাধ্যমে আলু, গম, আদা, তেলবীজ, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, ভুট্টা, লবন চাষে অর্থায়ন করা হয়ে থাকে।