ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেলের জন্য জাইকার ২,৪৬০ কোটি টাকার অব্যবহৃত তহবিল ফেরত যাচ্ছে
দেশের রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাসের মধ্যেও – বিদেশি অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘদিনের সমস্যা – বিলম্বের ধারাবাহিকতা চলছেই। এরমধ্যে দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রো রেল প্রকল্পের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই অর্থবছরের জন্য জাপানের ঋণের বরাদ্দ অর্থ তারা ব্যবহার করতে পারেনি।
ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট-১ প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও দরপত্র অনুমোদন করতে না পারায় – ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) – অব্যবহৃত ২,৪৬০ কোটি টাকার তহবিল ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাজধানী ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল রুট নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া ডিএমটিসিএল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) এই সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে।
এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, দুর্বল রাজস্ব আদায় ও বৈদেশিক অর্থায়ন আসার ধীর গতিতে আর্থিক চাপের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ; এই অবস্থায় অব্যবহৃত তহবিল ফেরত দেওয়া আশঙ্কা জাগায়।
এমআরটি-১ প্রকল্প পরিচালক আবুল কাশেম ভুঁইয়া টিবিএসকে জানান, ভূমি অধিগ্রহণ ও ঋণদাতা সংস্থার পক্ষ থেকে ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদনসহ বিভিন্ন জটিলতার কারণেই মূলত বরাদ্দকৃত তহবিল ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকার এ প্রকল্পের অধীনে রয়েছে: পাতাল ও উড়াল মিলে ৩১.২৪ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৯ সালে এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, নির্মাণ কাজ শুরু না হওয়ায় চার বছরে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র মাত্র ৩.৪৭ শতাংশ।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, প্রকল্প কাজ করা হবে ১২টি প্যাকেজের আওতায়। এরমধ্যে ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নের মাধ্যমে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও – নির্মাণসংক্রান্ত প্যাকেজগুলো এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
চারটি প্যাকেজে আন্ডারগ্রাউন্ড অংশের রেললাইন ও স্টেশনের পুরো কাজ চলতি অর্থবছরে শুরুর পরিকল্পনাও করেছিল ডিএমটিসিএল। এজন্য ৩ হাজার ৯১০ কোটি টাকা এ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়, এরমধ্যে বিদেশি তহবিল ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
করতে পর্যাপ্ত বরাদ্দও রেখেছিল ডিএমটিসিএল। তবে আগামী জুন নাগাদ মাত্র একটি প্যাকেজের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।
কিন্তু, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩৯.৯০ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ১.০২ শতাংশ। ঋণদাতা জাইকার থেকে চারটি প্যাকেজের অনুমোদন পেতেও দেরি হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক আবুল কাশেম ভুঁইয়া বলেন, এই চারটির মধ্যে একটি প্যাকেজের চূড়ান্ত অনুমোদন ২০২৪ সালের জুনে পাওয়া যেতে পারে। তাই এসব প্যাকেজের মোবিলাইজেশান অ্যাডভান্স (প্রাথমিকভাবে ঠিকাদারকে দেওয়ার জন্য বরাদ্দ অর্থ) অর্থ ফেরত দেওয়া হচ্ছে।
ফলে ২০২৬ সালে প্রকল্প কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। এই বিলম্বের কারণে প্রকল্পের সার্বিক ব্যয়ও বাড়বে।
এই দেরীর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান– পলিসি রিসার্চ ইনস্টটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএস'কে বলেন, 'প্রকল্পটি থেকে প্রত্যাশিত সুফল পেতেও এর ফলে দেরী হবে।"
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে গুরুত্ব দিয়ে মেগা প্রকল্পটি হাতে নেয়া হলেও, কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়নে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, আবার পরিকল্পনারও ঘাটতি রয়েছে।
তিনি বলেন, "আগামী অর্থবছরে যদি নির্মাণ কাজ শুরু হয়, তাহলে প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে হাতে সময় থাকবে মাত্র আড়াই বছর, বাস্তবে যা অসম্বব। এর ফলে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় উভয়েই বাড়বে। একইসঙ্গে প্রকল্পের সুবিধাও বিলম্বিত হবে।"
ডিএমটিসিএল এর তথ্যমতে, প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাইকা।
তহবিল ফেরত দিচ্ছে কেন হচ্ছে?
ডিএমটিসিএল এর সূত্রমতে, গতবছরের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জাইকার কাছে চারটি প্যাকেজ অনুমোদনের প্রাথমিক প্রস্তাব পাঠানো হয়। সে অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে সংস্থাটির কাছে দরপত্র সংক্রান্ত কাগজপত্র পাঠানো হয়। তবে জাইকা চারটি প্যাকেজ সংশোধনের পরামর্শ দেয় এবং একটিতে প্রাথমিক অনুমোদন দেয়।
অনুমোদিত প্যাকেজের জন্য গত ২৬ জুন দরপত্র আহ্বান করা হয়, এরপর টেন্ডার বক্স খোলা হয় গত ১৪ নভেম্বরে।
তবে ঠিকাদার চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে আগে জাইকার পর্যালোচনা দরকার হয়। দরপত্র আহ্বানের পর জাইকার কারিগরি পর্যালোচনা, কারিগরি সম্মতি ও কারিগরি অনুমোদনের দরকার হয় বলে জানায় সূত্রগুলো। এসব পর্যায়ের অনুমোদন লাভের পরেই ডিএমটিসিএল এর বোর্ড চূড়ান্তভাবে ঠিকাদার নিয়োগ করতে পারবে।
ডিএমটিসিএল- এর সূত্রগুল্লো আরও জানায়, চূড়ান্ত অনুমোদন লাভের পর ভূগর্ভস্থ অংশের প্যাকেকের কাছ সম্পন্ন করতে পাঁচ বছর লাগবে। ফলে নির্ধারিত সময়ের পরে গড়াতে পারে দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ।
অনুমোদিত প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা স্বীকার করে প্রকল্প পরিচালক আবুল কাশেম ভুঁইয়া বলেন, এই প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগ চলতি অর্থবছরে শেষ হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই বরাদ্দ অর্থ ফেরত দেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের যে প্রভাব পড়ছে
এমআরটি-১ প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিলম্ব রাজধানীতে তীব্র যানজট নিরসনে সরকারের উদ্দেশ্যকে সংশয়ের মধ্যে ফেলবে।
প্রকল্প কর্মকর্তাদের মতে, দৈনিক আটটি কোচযুক্ত ২৫টি ট্রেন এ লাইনে চলাচল করবে। প্রতিটি ট্রেনের সর্বোচ্চ যাত্রীধারণ সক্ষমতা হবে ৩ হাজার ৮৮ জন। এমআরটি-১ চালু হলে দৈনিক ৮ লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারবেন।
এতে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুরে যাওয়া যাবে মাত্র মাত্র ৩৪ মিনিটে। নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল যেতে লাগবে মাত্র ২০ মিনিট এবং ৩৫ মিনিটেই কমলাপুর থেকে পূর্বাচল পৌঁছানো যাবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, অনুমোদনের চার বছরেও মেট্রো রেলের মত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নির্মাণ কাজ শুরু করতে না পারা হতাশার। ইতোমধ্যেই, রাজস্ব ঘাটতি, বিদেশি মূদ্রার রিজার্ভে পতন, বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতার কারণে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই মূহূর্তে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি সহায়তা ফেরত দেয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, রাজস্ব ঘাটতি, বিদেশি মূদ্রার রিজার্ভে পতন, বিনিময় হারে চাপের কারণে সরকারের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশি সহায়তা ফেরত গেলে এ সব আরও বাড়বে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
"দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়, এ অবস্থায় বিদেশি সহায়তা ফেরত গেলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে"- যোগ করেন তিনি।