১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল, ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে
প্রাথমিক জ্বালানির তীব্র সংকটকালে সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপে তেল ও গ্যাসের নতুন মজুতের সন্ধান পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এতে তেলের মজুত ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ব্যারেল ও গ্যাসের মজুদ প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুট।
রোববার (১০ ডিসেম্বর) জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, 'প্রথম দিন সেখান থেকে ৭০ ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছি। এই কূপ থেকে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ ব্যারেল তেল উত্তোলন করা সম্ভব হবে।'
সিলেট-১০ নং কূপে গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার জানান, পরীক্ষা শেষে পুনর্মূল্যায়ন করলে ২০০–৩০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেতে পারে।
বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী এই মজুতের তেল ও গ্যাসের মূল্য প্রায় ২.৮ বিলিয়ন ডলার বা ২৪ হাজার কোটি টাকা। তেলের মূল্য ৭ হাজার কোটি টাকা এবং গ্যাসের মূল্য প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।
মজুতের সবটুকু তেল-গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হলে তা দিয়ে প্রায় এক মাসের তেলের চাহিদা ও দুই-তিন মাসের গ্যাসের চাহিদার মেটানো সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রতিমন্ত্রী জানান, কূপের ১,৩৯৭ থেকে ১,৪৪৫ মিটার গভীরতায় পৃথক একটি জোনে গত ৮ ডিসেম্বর টেস্ট করে তেলের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, উত্তোলিত তেলের নমুনা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইস্টার্ন রিফাইনারি ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডে পাঠানো হয়েছে। তেলের প্রকৃত মজুত জানতে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে, এতে প্রায় চার-পাঁচ মাস সময় লাগবে।
সিলেটের কূপে আলাদা আলাদা স্তরে তেল ও গ্যাসের সন্ধান মিলেছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'আগে গ্যাসের সঙ্গে কিছু তেল আসত, যা কনডেনসেট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন তেল ও গ্যাস আলাদা পাওয়া যাবে; এটা সবার জন্য একটা ভালো খবর।'
নসরুল হামিস আরও বলেন, এই মজুত স্থায়ী হওয়া নিয়ে তিনি আশাবাদী। 'আমরা আশাবাদী যে এই মজুত স্থায়ী হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের সিনোপ্যাক কাজ করবে, আমরা তেল উত্তোলন করে ব্যবহার করব।'
সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সাধারণত এ অঞ্চলে তেলের মজুদ পাওয়া যায় না। এখানে পাওয়া গেছে। প্রকৃত মজুত সম্পর্কে জানতে পাঁচ-ছয় মাস সময় লাগবে। আরও স্টাডি করে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে হবে।'
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা বছরে প্রায় ১০০.৭১ মিলিয়ন ব্যারেল। এর মধ্যে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ৩.৫ মিলিয়ন ব্যারেল।
নতুন পাওয়া গ্যাস
সিলেট-১০ নম্বর কূপে তেলের পাশাপাশি ২ হাজার ৫৭০ মিটার গভীরতায় গ্যাসের আরও মজুত পাওয়ার তথ্যও জানিয়েছেন নসরুল হামিদ।
তিনি জানান, চারটি স্তরে গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নিচের স্তরে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রবাহ পাওয়া গেছে, যার ফ্লোয়িং প্রেশার ৩,২৫০ পিএসআই (গ্যাসের চাপ মাপার একক)। এ স্তরে গ্যাসের মজুতের পরিমাণ ৪৩.১ বিলিয়ন ঘনফুট।
এছাড়া, ২,৪৬০ থেকে ২,৪৭৫ মিটার গভীরে দ্বিতীয় একটি স্তর পাওয়া গেছে, এখানে টেস্ট করলে ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উত্তোলন করা হলে এই মজুত ১৫ বছরের বেশি স্থায়ী হবে।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বর্তমানে পেট্রোবাংলা প্রায় ৪৬টি ড্রিলিং শুরু করেছে। আরও ১০০ ড্রিলিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংস্থাটি। আগামী দুই বছরের মাথায় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করার লক্ষ্য রয়েছে।
তিনি বলেন, '২০২৭ সালের পর আমাদের গ্যাসের ব্যবহার বেড়ে ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট হবে। আমরা যে প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাতে ওই সময় আমরা গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হব।'
বাংলাদেশে বার্ষিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী, দেশে মোট গ্যাসের মজুত ৪০.২৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট এবং উত্তোলনযোগ্য প্রমাণিত এবং সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ২৮.৬২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।
বর্তমানে দেশের ২১টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে, যেখানে দৈনিক প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে দৈনিক প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। এতে দৈনিক প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
১৯৬০ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জীভূত গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৯.৯৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ফলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে উত্তোলনযোগ্য অবশিষ্ট মজুতের পরিমাণ ছিল ৮.৬৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।
পূর্ববর্তী তেল আবিষ্কার
বাংলাদেশে তেলের মজুত আবিষ্কারের ঘটনা এবারই প্রথম নয়।
দেশে ১৯৮৬ সালের হরিপুর ফিল্ডে প্রথম তেল আবিষ্কৃত হয়। কর্তৃপক্ষ তখন ড্রিলিং স্ট্যাম্প টেস্টের মাধ্যমে দৈনিক ৫০০ ব্যারেল তেল উত্তোলনের ব্যবস্থা করে।
১৯৯৫ সাল পর্যন্ত হরিপুর তেলক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন করা হয়। এরপর সরকার এই ক্ষেত্র বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয় বলে সিদ্ধান্ত নেয়, এবং এটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে।
২০১২ সালে প্রথম বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক তেলের মজুত আবিষ্কৃত হয়। সিলেটের দুটি গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া যায় এ মজুত।
পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন মনসুর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'এই প্রথম আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক তেলের মজুত পেয়েছি, যার প্রাক্কলিত পরিমাণ প্রায় ১৫৩ মিলিয়ন ব্যারেল।'