ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে আলু-সরিষার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত
ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম ভারতের স্থলভাগে আঘাত হানলেও এর প্রভাবে বাংলাদেশে টানা দুই দিন বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টিতে দেশের মুন্সিগঞ্জে রোপণ করা বেশিরভাগ আলুর জমি এবং বিভিন্ন জেলায় সরিষা উৎপাদন ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সরকারের প্রাথমিক ক্ষতির হিসাব অনুসারে, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জসহ ১৫টি জেলায় মোট ১৩ হাজার ৮৭৭ হেক্টর জমির আলুর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে।
এর মধ্যে অধিক আলু উৎপাদনের জন্য পরিচিত মুন্সিগঞ্জে জেলায় মিগজাউমের আগপর্যন্ত ১৬ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১২ হাজার ৭৬২ হেক্টর জমিই ক্ষতির মুখে পড়েছে।
ক্ষতির প্রতিবেদন ও উৎপাদনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড দেখতে পেয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি আলুর ফলন ছিল ২২.৯০ টন। এই ফলন ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, প্রায় ৩ লাখ ১৮ হাজার টন আলুর উৎপাদনের সম্ভাবনা ছিল ক্ষতির মুখে পড়া জমিগুলো থেকে।
ক্ষতিগ্রস্ত জমির পুরো আলু নষ্ট হয়ে গেলে বর্তমানের প্রতি কেজির বাজারদর ৫০ টাকা ধরে হিসাব করলেও এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অনেক কৃষকের হয়তো সবটুকু জমির আলুই নষ্ট হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে এটা জাতীয় উৎপাদনে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।
তবে তিনি বলেন, 'সারা দেশে আলুর বীজ ডিস্ট্রিবিউশন হয়ে গেছে। যে কারণে মুন্সিগঞ্জে বীজের একটা সংকট হতে পারে। এ কারণে হয়তো কিছু জমি আলু চাষাবাদের বাইরে থাকতে পারে।'
মুন্সিগঞ্জে খোজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকের জমিতে অপরিনত আলু ও রোপ করা বীজ পচে যাচ্ছে। এই অবস্থায় কিছু কিছু কৃষক অপরিণত কিছু আলু তুলে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। যেসব কৃষক বৃষ্টির সপ্তাহখানেক থেকে বৃষ্টির এক দুদিন আগেও আলু লাগিয়েছিল তাদের আলু বীজ অবস্থাতেই নষ্ট হয়ে গেছে।
গত ৫ ডিসেম্বর ভারতে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম। এই প্রভাবে হওয়া বৃষ্টিপাতে বাংলাদেশের যে ১৫টি জেলায় এসব ফসলের উৎপাদন ক্ষতির মুখে পড়েছে সেগুলো হলো: ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা ও নড়াইল।
মুন্সিগঞ্জের কৃষকদের দুরবস্থা
মুন্সীগঞ্জে শতাধিক কৃষকের খেতে অপরিপক্ব আলু ও সদ্য রোপণ করা বীজ পচে যাচ্ছে। এই দুর্দশায় পড়ে কিছু কৃষক অপরিপক্ব আলু সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে তাদের সাধ্যমতো ক্ষতি কমাচ্ছেন।
এদিকে অতিবৃষ্টি শুরু হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ থেকে এক-দুদিন আগে যারা সম্প্রতি আলু রোপণ করেছেন, তাদের সম্পূর্ণ আলুর বীজ সরবরাহই নষ্ট হয়েছে। বীজ ব্যবসায়ী ও আলু চাষি উভয়পক্ষই এখন মুন্সিগঞ্জে আসন্ন রোপণ মৌসুমে আলু বীজের সম্ভাব্য সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন।
মুন্সিগঞ্জ কৃষি অফিসের তথ্যানুসারে, জেলায় যে পরিমাণ জমি চাষ করা হয়েছিল সেখানে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মণ আলু বীজ লেগেছে। এ আলু চাষের পেছনে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১৮৩ কোটি টাকা।
সিরাজদীখান উপজেলার কৃষক রহমান শেখ বলেন, 'আমি এবার ৭০০ শতাংশ জমিতে আলু রোপণ করেছি। আমার রোপণ করা বীজ আলু একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। পুনরায় আলু রোপণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এতে আমার লাখ লাখ টাকা লোকসান হবে।'
গজারিয়া উপজেলার কৃষক মো. জসিম উদ্দিন প্রধান আলু চাষ করে ইতিমধ্যেই দু-দুবার ধাক্কা খেলেন। প্রথমকবার ঘূর্ণিঝড় মিধিলিতে তার সব আলু জমিতে পচেছে, পুনরায় লাগানোর পর আবার মিগজাউমের বৃষ্টিতে সব পচে যাচ্ছে।
জসিম বলেন, 'দুই দফায় আমার দেড় লাখ টাকা ক্ষতি হয়ে গেল।'
বাংলাদেশে আলু উৎপাদন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যঅনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪.৫৫ লাখ হেক্টর জমিতে আলুর উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৪ লাখ টন। এ বছর সরকার ৪.৬২ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
গত অর্থবছরেও বৃষ্টিতে আলুর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল—কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন এমন দাবি করলেও সরকার সেটা স্বীকার করেনি।
তবে এ বছর তিন-চার মাস ধরেই ৫০-৬০ টাকা দামে আলু কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। সরকার আমদানি করেও বাজার সামাল দিতে পারেনি।
অন্যান্য ফসলের ক্ষতি
ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু আলুই নয়, এর বাইরেও গম, ভুট্টা, সবজি, পেঁয়াজ, ডালসহ আমনের অল্প কিছু পাকা ধান ও বোরোর বীজতলার ক্ষতি হয়েছে মিগজাউমে।
দেশের মোট ১৫টি জেলায় এসব কৃষিপণ্য উৎপাদন ক্ষতির মুখে পড়েছে। ক্ষতির দিক থেকে আলুর পরেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে সরিষার জমি।
সব মিলিয়ে বিভিন্ন ফসলের ৪৮ হাজার ৫৫৬ হেক্টর জমি ক্ষতির মুখে পড়েছে, যেখানে নানা ধরনের ফসলের চাষ হচ্ছে।
সরকার যখন সারা দেশে তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে, তখনই ২২ হাজার ৪০২ হেক্টর জমির সরিষা ফসল নষ্ট হয়ে গেল মিগজাউমে।
২০২১-২২ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি সরিষার উৎপাদন ছিল ১.২৩৮ টন। বর্তমানে প্রতি মণ সরিষা প্রায় ৩ হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।