বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান হলেন সমাজবিজ্ঞান পড়ুয়া একজন আমলা!
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের নতুন পরিচালক হিসেবে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী একজন আমলাকে নিয়োগ দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
এমন সিদ্ধান্তে বন গবেষক ও সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘকালের প্রথা ভাঙা হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন তারা।
বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের দীর্ঘ ৬৮ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা ঐতিহাসিকভাবেই বন ও পরিবেশ বিষয়ে নিবেদিত গবেষক হয়ে থাকেন, যাদের বিস্তৃত গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা দেশের বন শিল্পে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী হয়েও বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের পদ পাওয়ায় যুগ্ম-সচিব শামীমা বেগমের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এই খাতের গবেষকদের আশঙ্কা, অভ্যন্তরীণ যোগ্য কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করে এভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে তা দেশের গবেষণা প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে।
বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. রফিকুল হায়দারের অবসর কার্যকর হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় ২৫ সেপ্টেম্বর।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব শওকতুল আম্বিয়া স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে শামীমা বেগমকে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের নতুন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা শামীমা বেগম ২০তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারে নিযুক্ত হন। পরিচালক পদের নিয়োগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্ম সচিবকে নিয়োগের সিদ্ধান্তটি আসতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।
বিশিষ্ট বন গবেষক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আকতার হোসেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব পর্যায়ে একজন অভিজ্ঞ গবেষকের ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে বলেন, কখনও কখনও বন গবেষণার ফলাফল পেতে ৫০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
তিনি বলেন, "একজন গবেষককে তার তত্ত্বাবধানে সংগৃহীত কমপক্ষে ৩০ বছরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করতে হয়। যদি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের গবেষণায় কমপক্ষে ২৫-৩০ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকে, তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া তার পক্ষে চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়।"
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের সাবেক অধ্যাপক কামাল হোসেন দিয়ে বলেন, "এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের দায়িত্ব প্রশাসনিক দায়িত্বের মতো নয়। পরিচালককে অবশ্যই গবেষণা প্রচেষ্টার তত্ত্বাবধান এবং একইসঙ্গে এর সমন্বয় করতে হবে; আর এরজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট গবেষণা ব্যকগ্রাউন্ডের একজন দক্ষ নেতার।"
ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় কর্মকর্তা (প্রশাসন) ড. মাহবুবুর রহমান আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং গবেষকদের সাথে যোগাযোগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিচালকের ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে বলেন, "গবেষণার অভিজ্ঞতা নেই এমন একজন পরিচালক প্রতিষ্ঠানের সুনামকে বিপন্ন করতে পারে।"
যদিও ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদে যুগ্ম সচিব শামীমা বেগমকে নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই অনেক ভেবে-চিন্তে প্রতিষ্ঠানের কল্যাণেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
চট্টগ্রাম জেলার সিটিজেনস ফর গুড গভর্ন্যান্স (সুজন)- এর সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ক্রমবর্ধমানভাবে দেশে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে শুরু করছে।
তিনি আরও বলেন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ লুট করতে একজন আমলাই যথেষ্ট।
"প্রতিষ্ঠান জাহান্নামে গেলেও আমলারা তাতে ভ্রূক্ষেপ করেন না," যোগ করেন তিনি।
১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইস্ট পাকিস্তান ফরেস্ট রিসার্চ ল্যাবরেটরি এখন বাংলাদেশ ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণ করা হয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করছে এটি।
চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর। দেশের আটটি অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের বন তত্ত্বাবধানের পাশপাশি মাঠ পর্যায়ে ৫টি বিভাগের অধীনে ২১টি গবেষণা কেন্দ্র ও সাবস্টেশন পরিচালনা করছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠান।