আবারও অস্থির পেঁয়াজের বাজার
ভারতের রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর পরই অস্থির হয়ে উঠেছিল পেঁয়াজের বাজার। তখন পণ্যটির দাম ঠেকেছিল ২২০ টাকায়। এরপর বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনের তদারকিতে পেঁয়াজের দাম কমে ১০০ টাকায় নেমে আসে। তবে সপ্তাহ পার না হতেই আবারও দাম বৃদ্ধি পেয়ে এখন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৮০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের কাঁচাপণ্য (পেঁয়াজ, রসুন ও আদা) ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের সরবরাহ একবারেই কম। খাতুনগঞ্জের শতাধিক আড়তের মধ্যে মাত্র ৪-৫টিতে অল্প পরিমাণে পেঁয়াজ আছে। মূলত সরবরাহ সংকটের কারণে পেঁয়াজের দাম আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমদানিকারকরা জানান, আপাতত সংকট থাকলেও ইতোমধ্যে নতুন মৌসুমের দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু হয়েছে। ভারতও যেকোনো সময় রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে দিতে পারে। এই অবস্থায় বর্তমানে ১২০ টাকায় ডলারের বিনিময় মূল্য ও ১২০-১৫০ শতাংশ মার্জিন দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি করে মুনাফা করতে পারবে কি না, তা নিয়ে তারা শঙ্কিত। তাই ঝুঁকি নিয়ে কোনো আমদানিকার পেঁয়াজ আমদানি করছে না।
ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পর বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি না হওয়ার প্রমাণ মিলেছে প্ল্যান কোয়ারেন্টাইন স্টেশনের তথ্যেও। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, গত ৮ ডিসেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে মাত্র দুটি পেঁয়াজের চালান এসেছে। এরমধ্যে ঘোষণার পরেরদিন, ৯ ডিসেম্বর ৫৮ টন পেঁয়াজ এসেছে চীন থেকে এবং ১৩ ডিসেম্বর ৫৮ টন পেঁয়াজ এসেছে পাকিস্তান থেকে। ঘোষণার পর দেশের বাজারে প্রবেশ করলেও আমদানি হওয়া এসব পেঁয়াজের আমদানি প্রক্রিয়া হয়েছে কমপক্ষে আরও এক মাস আগে। সেই হিসেবে, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পর বিকল্প দেশ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো পেঁয়াজ আমদানি হয়নি।
এর আগে, গত ১৯ আগস্ট ভারত ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করলে বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই ঘোষণার পর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্য়ন্ত পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৪১৯ টন। এরমধ্যে পাকিস্তান থেকে ১,২১৮ এবং চীন থেকে ১,২০৮ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।
এর আগে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এসব দেশ থেকে কোনো পেঁয়াজ আমদানি হয়নি বলে জানিয়েছেন প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন স্টেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সৈয়দ মুনিরুল হক।
খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে এখন নতুন মৌসুমের দেশীয় পেঁয়াজ, এবং ভারত ও চীন থেকে আমদানিকৃত অল্প পরিমাণ পেঁয়াজ রয়েছে। এরমধ্যে পাইকারি পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজ ১১০ টাকা, চীনা পেঁয়াজ ১২০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ ১২০-১৩০ টাকা, চীনা পেঁয়াজ ১৬০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১৮০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের কাঁচা পণ্য ব্যবসায়ী ও মেসার্স গ্রামীণ বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী বলয় কুমার পোদ্দার বলেন, "বাজারে শতাধিক কাঁচাপণ্যের আড়ত রয়েছে। যার মধ্যে বর্তমানে পেঁয়াজ আছে সর্বোচ্চ ১০-১৫টি আড়তে। বেশিরভাগ দোকানে পেঁয়াজ না থাকার সুযোগে আমদানিকারকদের নির্দেশে কমিশন এজেন্টরা এই দাম বৃদ্ধি করেছে।"
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, "বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজ ছাড়া অল্প পরিমাণে ভারতীয় ও চীনা পেঁয়াজ আছে। তবে তা ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আগে এলসি করা।"
এই বিষয়ে খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কো কাঁচাপণ্য (পেঁয়াজ রসুন আদা) ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস মিয়া বলেন, "ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যায়। এরমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার তদারকিতে দাম কিছুটা কমলেও চলতি সপ্তাহ থেকে আবারও দফায় দফায় বেড়ে বাজার এখন অস্থির।"
তিনি আরও বলেন, "নিষেধাজ্ঞার পর বিকল্প দেশগুলো থেকে পেঁয়াজ আমদানির কোনো খরব আমরা পাইনি। তাই সরবরাহ সংকটের কারণে বাজার বাড়তি। আমদানি না হলে পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক হতে কমপক্ষে আরো দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। কারণ নতুন মৌসুমের দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে আসলেও তা এখনো অপরিপক্ব এবং চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।"
আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বাজারে দেশীয় পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের কাঁচাপণ্যের কমিশন এজেন্ট সৌমিক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন বলেন, "দেশের ভোক্তাদের কাছে দেশীয় পেঁয়াজের পরপরই ভারতীয় পেঁয়াজের চাহিদা বেশি। তাই বিভিন্ন সংকটের সময় আমদানিকারকরা বিকল্প দেশ হিসেবে মিয়ানমার, চীন, পাকিস্তান, মিশরসহ কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করলেও চাহিদা কম থাকায় এসব দেশের পেঁয়াজে খুব বেশি লাভ করতে পারেন না। এ কারণে এবারেও বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি না হওয়ায় বাজারে সরবরাহ সংকট রয়েছে।"
খাতুনগঞ্জের কাঁচাপণ্যের যে আড়ত বা দোকানগুলো রয়েছে, তারা বেশিরভাগ কমিশন এজেন্ট হিসেবে পণ্য বিক্রি করে। বিভিন্ন বর্ডারের আমদানিকারকরা কমিশন এজেন্টদের আড়তে পেঁয়াজ সরবরাহ করে। তবে ভারতীয় পেঁয়াজের সংকট হলে চট্টগ্রামের ফলমণ্ডির ব্যবসায়ীরা বিকল্প দেশগুলো থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেন।
কাঁচাপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স মক্কা-মদিনা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী নাজিম উদ্দিন বলেন, এই রকম সংকট হলে ব্যবসায়ীরা হুমড়ি খেয়ে বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেন। কিন্তু একই সময়ে কয়েকটি দেশ থেকে চাহিদার বাড়তি পেঁয়াজ চলে আসায় ব্যবসায়ীদের বারবার লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে। তাই ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলেও বিকল্প দেশগুলো থেকে এবার পেঁয়াজ আমদানি হয় নি।
অপর কাঁচাপণ্য আমদানিকারক এস কে হারামাইন'র স্বত্বাধিকারী মো. সরওয়ার আলম বলেন, চাহিদা ও আমদানির কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে বার বার লোকসান গুনতে হয়।
"এই মুহূর্তে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক থেকে এলসির অনুমোদন পাওয়া খুব কষ্টকর। এলসি পেলেও ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়তি এবং মার্জিন গুনতে হচ্ছে ১৫০ শতাংশ। ফলে বিকল্প দেশ থেকে নগদ টাকায় পেঁয়াজ আমদানি করে লাভ করতে পারবো কি না, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
এছাড়া, কোনো কারণে ভারত হঠাৎ করে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিলে তখন লোকসানের ঝুঁকি আরও বাড়বে। কারণ দেশি এবং ভারতীয় পেঁয়াজের থাকলে ভোক্তারা কখনও চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার তুরস্কের পেঁয়াজ কিনবে না। তাই লোকসানের ঝুঁকিতে এবারে ফলমণ্ডির কাঁচাপণ্য আমদানিকারকরা পেঁয়াজ আমদানি করেননি বলে জানান তিনি।