বাণিজ্যিকভাবে শৈবাল চাষ: ব্লু ইকোনোমির নতুন সম্ভাবনা
নুডলস, পাস্তা বা চাউমিনের সঙ্গে গাজর, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ ব্যবহার করা হয় খাবারের স্বাদ বা পুষ্টিগুণ বাড়াতে। এর পরিবর্তে যদি সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করা হয়, তবে কেমন হবে? শুনতে কিছুটা অদ্ভুত মনে হলেও এই শৈবাল বিশ্বের অনেক দেশে জনপ্রিয় খাদ্য। এবার বাংলাদেশেও এই খাদ্য পণ্যের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় দেড় বছর পাইলট প্রকল্প শেষে শৈবালের বাণিজ্যিক চাষ ও বাজারজাত করছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আউটলেটে বিক্রি হচ্ছে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ড্রাই সিউইড, সিইউড লেভার ও সিইউড পাউডার প্রজাতির প্যাকেটজাত শৈবাল। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পণ্যটি দেশীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানি বাজারেও পণ্যটি অবদান রাখতে পারবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিভাসুর ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রকল্পের প্রধান গবেষক ডা. মোহাম্মদ নুরুল আবছার খান জানান, শীতল আবহাওয়া, পরিষ্কার এবং বিশুদ্ধ নোনা পানিতে শৈবাল বেশি জন্মে। তাই এই প্রকল্পে কক্সবাজারের দরিয়া নগর থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ২২টি পয়েন্ট থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব নমুনা ল্যাবে পরীক্ষা করে শৈবাল চাষের জন্য কক্সবাজারের সালসা বিচ (কাকড়া বিচ) এবং উখিয়ার মনখালিকে উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। পরে এই দুই এলাকায় এত দিন ধরে মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এমন ২৫ জনকে নিয়ে শৈবাল চাষ শুরু করা হয়। মাছ ধরা ছাড়াও সাগরের পানিকে যে আরও বহুভাবে সম্পদে পরিণত করা যায় স্থানীয়দের কাছে সেটা তুলে ধরেছেন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা।
গবেষকরা জানান, পানির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বেশ কয়েকটি জাতের শৈবাল চাষের উপযুক্ত স্থান কক্সবাজার। এরমধ্যে অন্যতম জাত হল গ্রাসিলারিয়া ও উলবা ইন্টেস্টাইনালিস।
সামুদ্রিক শৈবাল মূলত শীত প্রধান এলাকার উদ্ভিদ। তাই বাংলাদেশে সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্য়ন্ত শৈবাল চাষের উপযুক্ত সময়। বীজ বপনের পর থেকে প্রতি ১৫-২০ দিন অন্তর-অন্তর শৈবাল চাষ করা যায়। এরপর শৈবালগুলোকে ভালেভাবে ধুয়ে সোলার টানেল, সোলার ট্রে এবং উন্মুক্ত জাল ড্রায়ার এই তিন পদ্ধতিতে শুকানো হয়।
শুকানো শৈবালগুলোকে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের নিউট্রিশন ও প্রসেসিং ল্যাবে খাদ্য পণ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। শৈবাল থেকে বর্তমানে সিভাসু শুকনো সি উইড, সামুদ্রিক শৈবালের গুঁড়ো এবং নুড়ি বা লেভার শিট এই তিন ধরণের খাদ্য বাজারজাত করেছে।
নুডুলস, পাস্তা, চাউমিন ও সুসিসহ জাপানিজ বিভিন্ন খাবারে শৈবালের ব্যবহার বেশি। সামুদ্রিক-শৈবালের নির্যাস সরাসরি খাওয়া যায়। আবার চাইলে অন্যান্য খাবার তৈরিতেও ব্যবহার করা যায়।
ইতোমধ্যে দেশের তারকা হোটেলগুলোতে বিদেশি খাবার রান্নার উপকরণ হিসেবে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যবহার বাড়ছে। তবে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে সুপার শপগুলো শৈবালের এই চাহিদা পূরণ করে থাকে। যা এখন সিভাসুর নিজস্ব ল্যাবে প্যাকেটজাত হচ্ছে।
সিভাসুর বাজারজাত করা এসব শৈবালের প্রতি ১০০ গ্রামে সাত ভাগ প্রোটিন এবং ৬৬-৬৯ ভাগ খনিজ রয়েছে। এছাড়া অন্যতম মিনারেলসগুলো হল ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন ও ফসফরাস।
এর মধ্যে লাল সামুদ্রিক শৈবাল দ্বারা উৎপাদিত প্রতি ১০০ গ্রাম পণ্যে ১০০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যালসিয়াম এবং ৫০০০ মিলিগ্রামের বেশি পটাশিয়াম রয়েছে। সবুজ সামুদ্রিক শৈবালের উৎপাদিত পণ্যে ক্যালসিয়াম রয়েছে ২৫০০ মিলিগ্রামের বেশি।
প্যাকেটজাত শেষে এই সামুদ্রিক শৈবাল বিক্রি হচ্ছে চট্টগ্রাম ভেটেনারি ও এনিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফুড আউটলেটে। এছাড়া পুষ্টিকর এই খাবারের বাজার সৃষ্টি ও সচেতনতা তৈরিতে নগরীর বিপ্লব উদ্যান, খুলশী মার্ট, এমএ আজিজ স্টেডিয়াম মোড়, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, ফয়েজ লেক ও পাহাড়তলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মোড়ে নিয়ম মেপে প্রচারণা চালাচ্ছে সিভাসুর নিজস্ব মার্কেটিং টিম।
সিভাসুর ফুড আউটলেটে সরবরাহ করা আইটেম তিনটির মধ্যে প্রতি ৫০ গ্রামের ড্রাই সিইউড ৭৫ টাকা, সিইউড লেভার (১২ পিস) ১৬৫ টাকা এবং ১০০ গ্রাম সিইউড পাউডার ১২৫ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ দেশের বিভিন্ন সুপার শপে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা প্যাকেটজাত শৈবাল বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে।
গবেষকরা জানান, উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত শেষে প্রতিকেজি শৈবাল বাজারে পৌঁছতে খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। যা মানভেদে সর্বনিম্ন ১০০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাজারে। সেই হিসেবে, উৎপাদন শেষে প্রতিকেজি শৈবালে দুই-তিন গুণ লাভের সম্ভাবনা রয়েছে।
সামুদ্রিক শৈবাল চীন, কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত। দেশে কম পরিচিত এই জলজ উদ্ভিদকে খাদ্য পণ্য হিসেবে অধিক পরিমাণে পরিচিতি করানোই ছিল গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য।
সেই উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক তরুণ গবেষকরা সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন এবং তা দিয়ে খাদ্য সামগ্রী প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাত শুরু করেন।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল মৎস্য অধিদপ্তর ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকল্পের গবেষণা সমন্বয়কারী সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ফয়সাল টিবিএসকে বলেন, "সামুদ্রিক শৈবাল হতে পারে সুনীল অর্থনীতির অন্যতম হাতিয়ার। সামুদ্রিক শৈবাল রয়েছে প্রচুর মিনারেলস ও ভিটামিন। এই বিপুল পরিমাণে মিনারেল এবং ভিটামিন আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যা হতে পারে ভবিষ্যতের সাগরের সুপারফুড।"
বৈশ্বিক বাজার ও সম্ভাবনা
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, সারা বিশ্বে বর্তমানে ১৩ মিলিয়ন মেট্রিকটন সিইউডের বাজার রয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১৫ বিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভের সমান। ২০২৮ সালের মধ্যে ২৫ বিলিয়নের বাজার তৈরিতে কাজ করছে বিশ্ব ব্যাংকের এই প্রকল্প।
অবশ্য বিশ্ব ব্যাংকের এই প্রকল্পের আগে বাণিজ্যিকভাবে শৈবাল চাষ ও বাজারজাত করে আসছেন কক্সবাজারের জাহানারা ইসলাম নামে এক নারী উদ্যোক্তা।
এছাড়া সেন্টমার্টিনসহ কক্সবাজারের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে শৈবাল আহরণ ও বিক্রি করে আসছে। তবে তা বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাত কিংবা প্যাকেটজাত হতো না। পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর লোকজন অল্প পরিমাণ শৈবাল খাবার হিসেবে কিনে নিতো। তাছাড়া স্থানীয়দের আহরণ করা বেশিরভাগ শৈবাল নামমাত্র মূল্যে মায়ানমারে চলে যায়। যা পরবর্তী সময়ে মায়ানমার হয়ে চীন, কোরিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
ড. মো. ফয়সাল আরো বলেন, "সামুদ্রিক শৈবাল চাষ দেশের জন্য এক সম্ভাবননময়ী খাত। এই খাতে বিনিয়োগে ঝুঁকির পরিমাণ খুবই কম। তাই যেকোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা উদ্যোক্তা এই খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন। এতে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় তথ্য ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিবে।"
সিভাসুর তৈরি এই সামুদ্রিক শৈবালকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছে। এরমধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আগামী সপ্তাহেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তি হবে বলে জানিয়েছেন ড. মো. ফয়সাল।