দেশেই সমুদ্র-শৈবাল থেকে তৈরি প্রসাধনী ও খাবার উৎপাদন করছেন তারা
বেশ কিছুদিন ধরে সিউইড, অর্থাৎ সমুদ্র-শৈবাল সম্পর্কে বিস্ময়কর সব তথ্য জানছি, পড়ছি। পুষ্টি ও ট্রেস মিনারেলসমৃদ্ধ এই 'সুপারফুড' একসময় কেবল উপকূলীয় এলাকার লোকজনই খেত।
সমুদ্রের ধারে বেড়ে ওঠা এই লাল, সবুজ ও বাদামি সমুদ্র-শৈবালের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে যত জানা যাচ্ছে, মানুষও তত বেশি এই খাবারটি খাচ্ছে।
প্রসাধনী, ফার্মাসিউটিক্যালস, সার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয় সমুদ্র-শৈবাল। অনেক দেশে এই উদ্ভিদ বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে বৈশ্বিক সিউইডের বাজারও উল্লেখজনক হারে বড় হচ্ছে।
এসব তথ্য জানা থাকলেও এতদিন বাংলাদেশে সমুদ্র-শৈবালের প্রসারের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানতাম না। সম্প্রতি আমার এক মেরিন কনজারভেশনিস্ট বন্ধু একটি বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের সিউইড স্যুপ নিয়ে রিভিউ করার পরই কেবল জানতে পারি যে এই ক্ষেত্রে দেশে সত্যিকারের অগ্রগতি হয়েছে।
বছর কয়েক ধরেই দেশে সীমিত পরিসরে সমুদ্র-শৈবালের চাষ হচ্ছে। স্থানীয় উদ্যোক্তারাই এখন বাংলাদেশে সিউইড-পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন।
এই সামুদ্রিক উদ্ভিদ থেকে অনেক ধরনের পণ্য তৈরি করছে কক্সবাজারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জাহানারা গ্রিন এগ্রো অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস।
জাহানারা গ্রিন এগ্রো অ্যান্ড ফুডের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জাহানারা ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তারা সমুদ্র-শৈবাল দিয়ে ১৩৮ ধরনের খাবার তৈরি করেছেন। 'আমাদের লক্ষ্য সিউইড দিয়ে প্রথাগত খাবার তৈরি করে সিউইডকে জনপ্রিয় করে তোলা। সিউইড পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আমরা পথিকৃৎ,' বলেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত খাবারের সংখ্যা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বৈচিত্র্যেও ভরপুর। জাহানারা গ্রিন এগ্রোর উৎপাদিত খাবারের মধ্যে আছে শিশুদের জন্য হরলিক্স-স্টাইলের ড্রিঙ্ক পাওয়ার, সবার জন্য কম চিনি দিয়ে বানানো মিষ্টান্ন এবং তেলবিহীন চিপস।
যেসব আইটেম জনপ্রিয় হবে, সেগুলো তৈরির ওপরই জোর দিচ্ছে জাহানারা এগ্রো। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা জাহানারা ইসলাম বলছেন, এই লক্ষ্যে তারা সফল।
জাহানারা বলেন, 'মানুষ একবার আমাদের সিউইডের স্বাদ চাখলে আল্লাহর রহমতে অপছন্দ করে না। খাবারগুলো খুব সুস্বাদু।'
বাংলাদেশে অসাধারণ স্বাদের কয়েক প্রজাতির সমুদ্র-শৈবাল আছে বলে জানালেন জাহানারা। এটি এই শিল্পের জন্য বাড়তি সুবিধা।
বরেন্দ্র অঞ্চলে অবস্থিত অন্যান্য দুধভিত্তিক খাদ্য শিল্পের সঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছে জাহানারা গ্রিন এগ্রো। ১ লাখ বোতল সমুদ্র-শৈবালের নির্যাস সরবরাহ করবে তারা। সমুদ্র-শৈবালের জ্যাম, জেলি ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হবে সেগুলো।
সমুদ্র-শৈবালের নির্যাস সরাসরি খাওয়া যায়। আবার চাইলে অন্যান্য খাবার তৈরিতেও ব্যবহার করা যায়। উদ্ভিদ বাছাই ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে সিউইডের খাবার তৈরি সহজ করে দেয় এই নির্যাস। সমুদ্র-শৈবালের সঙ্গে যাদের নতুন পরিচয় হয়, তাদের জন্য এই উদ্ভিদ বাছাই ও প্রক্রিয়াকরণ বাড়তি ঝামেলার কাজ।
কেবল খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় জাহানারার তৈরি সিউইড পণ্যের বৈচিত্র্য।
'আমরা সিউইড থেকে ২২টি প্রসাধনী পণ্যও তৈরি করেছি। এর মধ্যে ১৮টি পণ্য ফেসিয়াল প্যাকেজ, চুলের প্যাকেজ, পেডিকিউর-ম্যানিকিউর প্যাকেজ ইত্যাদির প্যাকেজে প্যাকেজে ব্যবহৃত এবং বিক্রি করা হয়,' জাহানারা জানালেন।
এছাড়া হাইড্রোপনিকসের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিও উৎপাদন করে তার প্রতিষ্ঠান। ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পানিতে যোগ করে সেই পানিতে ফসল উৎপাদন করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় হাইড্রোপনিক চাষাবাদ। সমুদ্র-শৈবাল ছাড়া হাইড্রোনিকস খাতটি পুরোপুরি রাসায়নিক ওপর নির্ভরশীল।
জাহানারা এগ্রোর কোনো আউটলেট নেই। তারা সারা দেশে অর্ডারের ডেলিভারি দেয়।
প্রতিষ্ঠানটির পত্তন ২০১০ সালে। তবে কৃষিতে জাহানারা ইসলামের যাত্রার শুরু ১৯৮০-র দশকের শুরুতে। ব্যবসায় স্নাতক ও গৃহিনী জাহানারা শুধু পরিবারের জন্য সবজি বাগান ও ছোট একটা পোল্ট্রি খামার শুরু করেন। পরে তার বাগান ও খামারের আকার বড় হয়। প্রথমে বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের নানা ধরনের খাদ্যপণ্য উপহার দিতেন তিনি। পরে সেগুলো বিক্রি শুরু করেন।
১৯৮৩ সালে সিউইড ফুড আইটেম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন জাহানারা। বর্তমানে তার ফার্মে ৫০-৬০ জন কর্মী আছে। এছাড়া প্রায় দুই লাখ ক্ষুদ্র কৃষক চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত।
জাহানারা গ্রিন এগ্রো সিউইড পণ্য ছাড়াও মাশরুম থেকে শুরু করে নারকেল ও কফি বিন থেকে চকলেট বিন পর্যন্ত অন্যান্য অনেক ফুড আইটেম উৎপাদন ও বাজারজাত করে।
এই অসাধারণ অর্জন এসেছে কেবল অভিজ্ঞতা ও কৃষির প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থেকে।
জাহানারা ইসলাম বলেন, 'কৃষিতে আমার কোনো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। আমার আবেগই আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে।'
এই উদ্যোক্তা জানালেন, তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি তার পরবর্তী প্রজন্মকে প্রস্তুত করেছেন।
তার তিন সন্তানই প্রকৌশলী। তবে তারা তাদের একাডেমিক এবং প্রযুক্তিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে তাদের মায়ের কাজকে আরও উন্নত করতে ভূমিকা রাখছে।
জাহানারা বলেন, 'আমরা দেশে উৎপাদিত কাঁচামাল দিয়ে আমাদের কৃষি-শিল্পের বিকাশ ঘটাতে চাই।'
স্বশিক্ষিত এই কৃষি-উদ্যোক্তা বলেন, ভবিষ্যতে তিনি সমুদ্র-শৈবালভিত্তিক সার, গবাদিপশুর খাদ্য ইত্যাদি উৎপাদনে যাবেন। এছাড়া শিল্প স্কেলে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনাও আছে তার।
জাহানারা গ্রিন এগ্রো অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টসের চেয়ারম্যান বলেন, 'শিল্প স্কেলে উৎপাদনের জন্য প্রতিদিন কয়েক টন সিউইডের প্রয়োজন হবে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকার মানুষ বিস্তীর্ণ উপকূলরেখা ব্যবহার করে প্রায় কোনো বিনিয়োগে না করেই উপার্জন করতে পারবে।'