অ্যানেস্থেশিয়ার ওষুধ হ্যালোথেনের উৎপাদন বন্ধ করল এসিআই, অস্ত্রোপচারের খরচ বাড়ার শঙ্কা
অস্ত্রোপচারের সময় দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত চেতনানাশক ওষুধ হ্যালোথেনের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড; এতে সারাদেশে অস্ত্রোপচারের খরচ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বড় ধরনের অপারেশনের সময় রোগীকে পুরোপুরি অচেতন করার জন্য এতদিন দেশে তুলনামূলক কম দামের হ্যালোথেন অ্যানেস্থেশিয়া ব্যবহার করা হতো। তবে শারীরিক ও পরিবেশগত ক্ষতির দিক বিবেচনা করে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) হ্যালোথেন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশেও এ ওষুধের উৎপাদন বন্ধ করেছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড। হ্যালোথেন ওষুধটি 'হ্যালোসিন' ব্র্যান্ড নামে উৎপাদন করতো এসিআই।
এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালক (বিপণন ও অপারেশন) মোহাম্মদ মুহসিন মিয়া বলেন, "আমরা ও ভারতের নিকোলাস পিরামল ইন্ডিয়া লিমিটেড হ্যালোথেন উৎপাদন করতাম। এফডিএ হ্যালোথেন ব্যান করে দেওয়ায় আমরা ওষুধটি আর উৎপাদন করব না। কয়েক মাস আগেই আমরা সব সরকারি হাসপাতালে চিঠি দিয়ে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছি। এখন হ্যালোথেনের বিকল্প ওষুধ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তবে এতে সময় লাগবে।"
হ্যালোথেনের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে ওষুধটির সংকট দেখা দিয়েছে। এর বিকল্প যে অ্যানেস্থেশিয়ার ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তার দাম বেশি হওয়ায় ও সেসব ওষুধ ব্যবহারের মেশিন অধিকাংশ হাসপাতালে না থাকায় বড় অস্ত্রোপচারে সমস্যা হচ্ছে।
তবে সরকারি হাসপাতালে ভ্যাপার মেশিন কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে; একইসঙ্গে আগামী অর্থবছরে হ্যালোথেনের বিকল্প অ্যানেস্থেশিয়ার ওষুধ ক্রয় তালিকায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান বলেন, হ্যালোথেনের বিকল্প যে ওষুধগুলো আছে যেগুলো ব্যবহারের জন্য মেশিন কেনা শুরু হয়েছে, ধাপে ধাপে সব হাসপাতালে মেশিগুলো সেট করা হবে।
তবে হ্যালোথেনের বিকল্প ওষুধ ব্যয়বহুল হওয়ায় বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় আরও বাড়বে বলে শঙ্কা চিকিৎসকদের।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেস্থেটিস্ট ডা. শোমান অনিরুদ্ধ বলেন, "আমাদের হাসপাতালে এখনও হ্যালোথেন কিছু স্টকে আছে, আমাদের দুটি অপারেশন থিয়েটরে সেগুলো ব্যবহার করা হয়। বাকিগুলোতে হ্যালোথেনের বিকল্প হিসেবে আইসোফ্লুরেন ও সেভোফ্লুরেন ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, সেগুলোর দাম হ্যালোথেনের তুলনায় দুই-তিন গুণ বেশি। এছাড়া হ্যালোথেনের ডিভাইস ইজি ডিভাইস ছিল, এর দামও কম। কিন্তু বিকল্প ওষুধগুলোর জন্য আলাদা ভ্যাপারাইজার মেশিন লাগবে। এখনও সব হাসপাতালে সেই মেশিন নেই।"
দেশে ২০০ এমএল হ্যালোসিনের দাম ১,৪০০ টাকা; সেখানে আইসোফ্লুরেনের দাম ৩,০০০ এবং সেভোফ্লুরেনের দাম ১২,০০০ টাকা। সরকারি চলতি অর্থবছরে হাসপাতালেগুলোতেও হ্যালোথেনের বিকল্প ওষুধ কেনা হয়নি। তাই কিছু কিছু সরকারি হাসপাতালে রোগীদের নিজেদের এই ওষুধ কিনতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের কেয়ারটেকার ডা. হারুন অর রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "আমাদের স্টকে এখনও কিছু হ্যালোথেন আছে। আরও এক-দুই মাস চালানো যাবে। তারপর রোগীদের নিজ খরচে অ্যানেস্থেশিয়ার বিকল্প ওষুধ আনতে বলা হবে, নাকি আমরা ভর্তুকি দিয়ে বিকল্প ওষুধ কিনবো– তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া বিকল্প অ্যানেস্থেশিয়া ওষুধ ব্যবহার করতে হলে নতুন মেশিনও প্রয়োজন হবে।"
দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ মো. নুরুজ্জামান সঞ্চয় জানান, "আমাদের হাসপাতালে গত ২ মাসেরও বেশি সময় ধরে হ্যালোথেন নেই। হাসপাতালে যে মেশিনগুলো আছে, তা হ্যালোথেন দিয়ে চলে। এটির উৎপাদন বিশ্বব্যাপী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে আইসোফ্লুরেন দিয়ে এখন অপারেশন চালানো হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে এই আইসোফ্লুরেন দিয়ে এই যন্ত্রপাতি ঠিক মতো চলবে না। এটি পরিবর্তন করতে হবে, এটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।"
রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উপপরিচালক আ. ম. আখতারুজ্জামানও একই কথা জানালেন। গত একমাস ধরে বিকল্প হিসেবে আইসোফ্লুরেন দিয়ে কাজ চালাচ্ছেন তারা।
তবে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এখনও হ্যালোথেনের সংকট দেখা দেয়নি। দেশে হ্যালোথেনের সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কার কথা ভেবে, আগে থেকেই এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হ্যালোথেন রিজার্ভ করে রেখেছিল।
এ প্রতিষ্ঠানের উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, "রিজার্ভ করা হ্যালোথেন দিয়ে আমাদের হাসপাতালে ১৫ থেকে ২০ দিন চলবে। বিকল্প হিসেবে আইসোফ্লুরেনও সংগ্রহে রাখা হয়েছে।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, "হ্যালোথেন এতদিন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালগুলোতে কেনা ছিলে; এখন যেহেতু সেগুলোর উৎপাদন বন্ধ, তাই এর বিকল্প ওষুধ আগামী অর্থবছরে ক্রয় তালিকায় যুক্ত করা হবে। তবে এখন রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে যেন অ্যানেস্থেশিয়ার ওষুধের খরচ না নেওয়া হয়, সেজন্য হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হবে।"