দেশে দারিদ্র্য কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য: বিবিএস প্রতিবেদন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, দারিদ্র্য কমা সত্ত্বেও দেশে ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আয় বৈষম্য উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) বিবিএস মিলনায়তনে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
জরিপে উঠে এসেছে, ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে গিনি সহগ ছিল ০.৪৯৯—গ্রামীণ এলাকায় ০.৪৪৬ ও শহরাঞ্চলে ০.৫৩৯।
গিনি সহগ (গিনি ইনডেক্স বা গিনি রেশিও) হচ্ছে একটি দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিসংখ্যানগত পরিমাপ। কোনো দেশের বৈষম্য যখন গিনি সহগ অনুযায়ী ০.৫০০ হয়, তখন ওই দেশটি উচ্চমাত্রার বৈষম্যে ভোগে।
০.৪৯৯ গিনি সহগ নিয়ে বাংলাদেশ এখন উচ্চমাত্রার বৈষম্যের কাছাকাছি রয়েছে।
২০১৬ সালে দেশে জাতীয় পর্যায়ে গিনি সহগ ০.৪৮২— গ্রামীণ এলাকায় ০.৪৫৪ ও শহরাঞ্চলে ছিল ০.৪৯৮।
আর ২০১০ সালে দেশে জাতীয় পর্যায়ে গিনি সহগের মান ছিল ০.৪৫৮— গ্রামীণ এলাকায় ০.৪৩১ ও শহরাঞ্চলে ছিল ০.৪৫২।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিবিএসের জরিপ প্রকল্পের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ।
সারাদেশে দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য হ্রাস পেলেও পরিবারপ্রতি আয় বেড়েছে বলেও জরিপে উঠে এসেছে।
জরিপে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে দেশে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য ছিল ২৪.৩ শতাংশ। ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার কমে জাতীয় পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে ১৮.৭ শতাংশে।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ও ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
তিনি বলেন, দারিদ্র্য কমার চেয়েও দেশে এখন বৈষম্য বৃদ্ধিই বেশি শক্তিশালী হয়ে দেখা দিয়েছে। আয়ের দিক থেকে নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৮ শতাংশ আছে। অন্যদিকে শীর্ষ ৫ শতাংশের হাতে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ আছে। উন্নয়নের বৈশিষ্ট্যের কারণে এই ধরনের বৈষম্য বাড়ছে।
এছাড়া বিভাগওয়ারি দারিদ্র্যের চিত্রও পাল্টে গেছে। এখন আর রংপুর বিভাগ বেশি দারিদ্র্যপীড়িত নয়, বরিশাল বিভাগ সেই জায়গা নিয়ে ফেলেছে।
উচ্চ ও নিম্ন দারিদ্র্যের বৃত্তে ঢুকে পড়েছে বরিশাল বিভাগ। ২০২২ সালে উচ্চ দারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার ২৬.৯ শতাংশ এবং নিম্ন দারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী দারিদ্র্যের হার ১১.৮ শতাংশ।।
অন্যদিকে, বিভাগগুলোর মধ্যে উচ্চ দারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী খুলনায় দারিদ্র্যের হার ১৪.৮ শতাংশ এবং ঢাকায় নিম্ন দারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী অতি দারিদ্র্যের হার ২.৮ শতাংশ।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি খুলনায় জেলায়। সেখানে বেশি দারিদ্র্য বাড়ার কথা। কিন্তু খুলনায় দারিদ্র্য কমেছে। অন্যদিকে শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় দারিদ্র্য বেড়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ঢাকায় কীভাবে দারিদ্র্য বাড়ল, তা দেখা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, দারিদ্র্য কমানোর প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা বেশি জরুরি। কারণ হঠাৎ আসা যেকোনো ধরনের আঘাতে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। তাদের সুরক্ষা দিতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচন টেকসই হবে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করে পরিবারের আয় দেখালে হয়তো দারিদ্র্য পরিস্থিতির আরেকটি চিত্র পাওয়া যেত।
অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম উপস্থিত ছিলেন। তারা আয়ের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের কথা স্বীকার করেন।
তারা বলেন, উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বৈষম্য বাড়ে এবং পরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
পরিবারগুলোর মাসিক গড় আয় দ্বিগুণ হয়েছে
বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেছে, গত ছয় বছরের ব্যবধানে দেশের মানুষের গড় আয়ও অনেকটা বেড়েছে।
জরিপ উঠে এসেছে, ২০২২ সালে দেশে পরিবারপ্রতি গড়ে আয় হয়েছে মাসে ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। ২০১৬ সালে পরিবারপ্রতি গড় আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে আয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। আর ২০১০ সালে পরিবারপ্রতি গড় আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা।
জরিপের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে গড়ে পরিবারপ্রতি মাসিক ব্যয় ছিল ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। ২০১৬ সালে প্রতি পরিবারে গড় মাসিক ব্যয় ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। আর ২০১০ সালের জরিপে দেখা গিয়েছিল পরিবারগুলো গড়ে মাসে ১১ হাজার ২০০ টাকা ব্যয় করেছিল।
বিবিএসে জরিপে আরও উঠে এসেছে, , ২০২২ সালে দৈনিক গড়ে মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ ৭২.৫ গ্রাম, যা ২০১৬ সালে ছিল ৬৩.৮ গ্রাম। এছাড়া ২০১০ সালে দৈনিক গড়ে মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ ৬৬.২৬ গ্রাম, ২০০৫ সালে ৬২.৫২ গ্রাম ও ২০০০ সালে ৬২.৫০ গ্রাম ছিল।
জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালে দেশের ৯৯.৩৪ শতাংশ পরিবার বিদ্যুৎ সুবিধা আওতায় রয়েছে। ২০১৬ সালে ৭৫.৯২ শতাংশ পরিবার ক ২০১০ সালে ৫৮.৯ শতাংশ পরিবার বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল। একইভাবে ৯২.৩ শতাংশ পরিবার উন্নত টয়লেট সুবিধার আওতায় আছে। আর ৯৬.১ শতাংশ পরিবার খাবার পানির জন্য উন্নত উৎসের সুবিধা পায়।
এছাড়া বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার (৭ বছর বয়সি বা তদূর্ধ্ব) ৮.৪ শতাংশ বেড়েছে। । ২০২২ সালে সাত বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭৪ শতাংশ, যা ২০১৬ ও ২০১০ সালে ছিল যথাক্রমে ৬৫.৬ ও ৫৭.৯ শতাংশ।