আট দশকের পুরনো স্বাদ এখনও অটুট মদনমোহনের মাখন-মাঠায়
কলসি আকৃতির মাটির পাত্রের ভেতরে রাখা হয়েছে জাল দেওয়া দুধ। এরপর তার ভেতরে বাঁশের মাথা ঢুকিয়ে রশি দিয়ে ঘোরানো হয়। বাঁশটি যেন পড়ে না যায়, সেজন্য শক্ত খুঁটির সঙ্গে তা বাঁধা হয়।
দুগ্ধমন্হর—দুধ থেকে মাখন তৈরির সনাতন পদ্ধতি এটি। চট্টগ্রাম নগরীর এনায়েত বাজার এলাকার ছোট্ট একটি দোকানে আজও জারি আছে সনাতন এই পদ্ধতি।
গ্রাম বাংলায় কয়েক দশক আগেও কায়িক শ্রমের মাধ্যমে এমন করে মাখন তৈরি হতো। কালের পরিক্রমায় এই ঐহিত্য হারিয়ে গেছে। তবে সেই দুগ্ধমন্হর পদ্ধতি আট দশকের বেশি সময় ধরে টিকিয়ে রেখেছে চট্টগ্রামের জরাজীর্ণ দোকানটি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মদনমোহন দাশের দোকানে এখনও বিক্রি হচ্ছে সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি মাখন, মাঠা ও দই। মদনমোহন মারা গেলেও তার উত্তরাধিকারীরা এখনও ধরে রেখেছেন দুগ্ধমন্হর পদ্ধতি। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে আছে আগের সেই স্বাদ।
পুরনো সেই স্বাদের কারণে দিনভর ভিড় লেগে থাকে প্রায় ২০০ বর্গফুটের দোকানটিতে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন ক্রেতা-ভোক্তারা। দোকানটির দই-চিড়া, মাখন-পাউরুটি, মাঠা এবং টক দইয়ের খ্যাতি-সুনাম এখনও বজায় আছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে এসব উপাদান খেতে বা কিনতে ছুটে আসে মানুষ।
সম্প্রতি দোকানে বসে দই-চিড়া খেতে খেতে শহরের সিএনজি অটোরিকশা চালক আবদুর রহিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '১৯৯৪ সাল থেকে এখানে এসে আমি দই-চিড়া ও মাঠা খাই। এখনও সেই আগের মতো স্বাদ অটুট আছে।'
দোকানের কর্মচারীরা জানান, প্রতিদিন সকালে ৬০-৭০ কেজি দুধ আনা হয়। এরপর তা জাল দিয়ে দুগ্ধমন্হর করে মাখন তোলা হয়। মাখন তোলার পর অবশিষ্ট দুধ জাল দিলেই মাঠায় পরিণত হয়।
প্রতি কেজি দুধ থেকে ৫০ গ্রাম মাঠা হয় বলে জানান তারা। আর আগের রাতে বসানো হয় দই। দৈনিক ৩ থেকে সাড়ে ৩ কেজি মাখন ওঠে। কোনো সময় তা দেড় কেজি বা দুই কেজিতেও নেমে আসে।
বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে শেষ হয়ে যায় মাখন। প্রতি কেজি মাখন ১ হাজার ৮০০ টাকা। পরিমাণে ৫০ গ্রাম থেকে শুরু করে চাহিদা অনুসারে বিক্রি করা হয়।
আবার পাউরুটিতে মাখন মাখিয়েও বিক্রি করা হয়। ৯০ টাকা থেকে শুরু করে পাউরুটির প্যাকেটের আকৃতি অনুসারে ৪০০ টাকায়ও বিক্রি করা হয়। মাঠা ও টক দই প্রতি কেজি ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। আর প্রতি গ্লাস বিক্রি করা হয় ২৫ টাকায়। দই-চিড়া প্রতি বাটি বিক্রি করা হয় ৩৫ টাকায়। চিনির পরিবর্তে গুড় দেয়া হয় দই-চিড়ায়। যার ফলে আলাদা সুনামও আছে।
শুরুর গল্প অজানা
মদনমোহনের দাশের মাখন-মাঠার দোকানটি ঠিক কখন চালু হয়েছিল, তা জানা যায়নি। বলা হয়, আট দশকের বেশি সময় আগের দোকানটির যাত্রা শুরু। ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মদনমোহন দাশ বলেছিলেন, দোকানটি কখন শুরু হয়েছিল তিনিও জানেন না।
ওই সাক্ষাৎকারে মদনমোহন জানান, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কচুয়া গ্রামে বাড়ি তার। স্থানীয় নলিনীকান্ত মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৫৬ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তিনি চট্টগ্রামে এসেছিলেন। ভোরের ট্রেনে শহরে এসে সারাদিন দোকান করে রাতের শেষ ট্রেনে ফিরতেন পটিয়ায় বাড়িতে। ওই সময় জুবিলী রোড়ের এনায়েত বাজারের মোড়কে বলা হতো বাদামতল। তখন এলাকাটি ছিল খোলা মাঠ। এখানে বিহারী ও পাকিস্তানিদের বসবাস ছিল বেশি। তাদের কাছে মাঠা ও মাখন বেশি জনপ্রিয় ছিল।
তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে উত্তরসূরি হিসেবে রেখে ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই মদনমোহন মারা যান। এর আগেই ব্যবসার হাল ধরেছিলেন তার ছেলে সঞ্জয় দাশ।
১৯৯৪ সাল থেকে সঞ্জয় বাবার দোকানে বসেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে রসায়নে মাস্টার্স সম্পন্ন করা সঞ্জয়ের সামনে চট্টগ্রাম বন্দর ও খাদ্য অধিদপ্তরের চাকরির সুযোগ এলেও বাবার ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত দোকানের হাল ধরেন।
সঞ্জয় দাশ টিবিএসকে বলেন, 'বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় দোকানের হাল ধরেছি। পরবর্তী প্রজন্ম ধরবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত তাদের ওপর।'
মাটির মটকা ও ক্যাশ বাক্স
দোকানটি আজও কয়েক দশকের পুরনো কাঠের তৈরি ব্রিফকেস আকৃতির ক্যাশ বাক্স ও মাখন তৈরির জন্য মাটির মটকা ব্যবহার করে।
সঞ্জয় দাশকেও প্রশ্ন করা হলে তিনিও মনে করতে পারলেন না ক্যাশ বাক্সটি কখনকার! তিনি বলেন, 'এটি সম্ভবত মিয়ানমার থেকে আনা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে কারুকার্য বা খোদাই করা এমন বাক্স তৎকালীণ বার্মার রাখাইন থেকে আসত। আমিও ছোটবেলা থেকে এই ক্যাশ বাক্সটি দেখে আসছি।'
সঞ্জয় জানান, দুগ্ধমন্হর করা হয় মাটির কলসি আকৃতির সিউ নামের এক ধরনের পাত্র, যাকে বাংলাদেশে মটকাও বলা হয়। একসময় এমন পাত্র কাঁধে নিয়ে গ্রামে হেঁটে হেঁটে মাঠা বিক্রি হতো। এটিও মিয়ানমার থেকে আসত।
বর্তমানে শুধু একটি পাত্র আছে দোকানে। এটিও ৩০-৪০ বছর আগের। এটি ভেঙে গেলে এসএস বা স্টিলের তৈরি পাত্র বানাতে হবে।
হারিয়ে গেছে হাঁড়ি-পলাশ পাতার প্রচলন
মদনমোহনের দোকানের আরেকটি বিশেষত্ব ছিল মাটির হাঁড়িতে দই ও মাঠা বিক্রি। আর মাখন বিক্রি করা হতো পলাশ পাতায় মুড়িয়ে। কালের পরিক্রমায় তা-ও হারিয়ে গেছে।
কুমারপাড়ার বিলুপ্তির ফলে মাটির হাঁড়ির দাম বাড়তে থাকে। ২০০০ সালের পর ব্যয় পোষাতে না পেরে পলিথিননির্ভর হতে হয়। আর পলাশ পাতার প্রচলন বন্ধ হয়ে যায় করোনা মহামারির সময়।
সঞ্জয় দাশ জানালেন, তাদের দোকানে সক্ষমতার বেশি অর্ডার নেওয়া হয় না। দৈনিক ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হয় দোকানে।