শতবার খেলেও প্রতি চুমুকে নতুন স্বাদ
"ঘোল-মাঠা-দই তো জীবনে অনেক খাইছেন; এবার সলপের ঘোল-মাঠা খায়া বলেন স্বাদে পার্থক্য কোন জায়গায়?" সলপ দই ঘরের মালিক আব্দুল খালেক খান আমাকে তার দোকানের বিখ্যাত এক গ্লাস ঘোল ও মাঠা এগিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে এ কথা বললেন।
এক চুমুকে ঘোলটুকু শেষ করে মনে হল যেন খাঁটি দুধ থেকে গাঢ়ভাবে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা তরল দই। এর আগেও সলপের ঘোল-মাঠা আমি অনেকবার খেয়েছি। হাজারবার খেলেও প্রতিবারের চুমুক আমার কাছে নতুন ঠেকে। আমার মতো ঘোল-মাঠা প্রেমিক যে ক'জন আছেন সবারই এমন লাগার কথা।
সলপের ঘোল সেরা নাকি মাঠা সেরা একথা বলা একদম অসম্ভবপ্রায়। তবে, মাঠাতে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই খেতে খানিকটা ঘোলের চেয়ে মুখরোচক। দামেও দইয়ের চেয়ে কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেশি।
সলপের দইয়ের ইতিহাস একশ' বছরের পুরোনো। ১৯২২ সালে সাদেক খান সলপে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোল-মাঠার পত্তন ঘটিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিক বলতে চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চি পেতে দোকান শুরু করেছিলেন।
সলপ বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন। সেকালে সলপ খুব উন্নত এলাকা ছিল না। স্যান্যাল জমিদারেররা তখন সলপ শাসন করত। সলপ রেল স্টেশনের ঠিক পশ্চিম দিকে সাদেক খান দোকান শুরু করেন। এখন সেখানে একসাথে চারটা দোকান। সবার সাইনবোর্ডে সলপ লেখা।
প্রশ্ন উঠতে পারে কে আসল এবং কে নকল? বা, কে কতখানি আসল কতখানি নকল? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে লেখার বাকিটা পড়তে থাকুন।
ঢাকা থেকে সলপ যেতে চাইলে প্রথমে আপনাকে পাবনাগামী বাসে উঠে পড়তে হবে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল গোলচত্ত্বর থেকে দক্ষিণে ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক ধরে ১০ কিলোমিটারের মতো এগিয়ে বাস আপনাকে উল্লাপাড়া স্টেশন বাসস্টপে নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা, ভ্যান বা লেগুনা চেপে যেতে হবে সলপ বাজারে। বাজারের এক কোণায় রেল স্টেশন। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাড়ালেই দেখবেন সলপের বিখ্যাত ঘোলের দোকানগুলো সারি ধরে আপনাকে ডাকছে।
সাদেক খানের সময়ে দুধ-মিষ্টি-ঘৃতের ব্যবসা পুরোটা ছিল হিন্দু ঘোষ-সাহা-মোদক সম্প্রদায়ের হাতে। সেই প্রতিকূল সময়ে সাদেক খান বগুড়া মতান্তরে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার চান্দাইকোনার কয়েকজন দই ও ঘোল নির্মাতার কাছে দুধের কারিগরির ব্যাপারে শিক্ষা নেন। তিনি দই-ঘোল বানানো শিখেছিলেন মূলত নিজের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য।
সলপে এসে ঘোল বানানো শুরু করে তিনি উন্নতি করতে পারলেন না। দেখা গেল সব ঘোষের দুধে দই হয়, তার দুধে হয় না। তিনি তার গুরুর শরণাপন্ন হলে গুরু তাকে বলেন, 'স্থানীয় ঘোষেরা তোমাকে খাঁটি দুধ দিচ্ছে না। ওরা বাপ-দাদার ব্যবসা হাতছাড়া করতে চায় না। তুমি বাজার থেকে একজনের কাছ থেকে দুধ না কিনে গ্রামের ভেতরে কয়েক জনের কাছ থেকে দুধ নাও।'
সাদেক খান তার কথামত কাজ করে সে যাত্রায় বেচে গেলেন। ধীরেধীরে তার বেচাকেনা বাড়া শুরু হল। সাদেক খানের নাতি খালেক খান পিতামহের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে বলেন, 'আমার দাদার তখন আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই করুণ। দই-ঘোল বানানোর বিদ্যা তিনি তার চার ছেলের বাইরে কাউকে শিখায়া যান নাই।"
সাদেক খানের চার ছেলে – সোবহান খান, তহেজ খান, আনসার খান, মান্নান খান। সবাই বাবার কাছ থেকে দই-ঘোল-ঘি বানানো শিখলেও সবাই ব্যবসার দিকে লেগে থেকে উন্নতি করতে পারেনি। তহেজ খান বাড়িতে ঘোল বানিয়ে ভাঁড়ে করে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বিক্রি করতেন।
১৯৮৭ সালে সাদেক খানের মৃত্যুর পরে তার সন্তানেরা দোকান ও ব্যবসা ভাগ করে নেয়। চার ভাইয়ের মধ্যে মান্নান খান দোকান সামলে থাকেন। '৮৮ সালের বন্যার পরে কিছুদিনের জন্য দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। চার বছর বন্ধ থাকার পরে মান্নান খানের দুই ছেলে মালেক খান ও খালেক খান আবার দোকান শুরু করেন।
মালেক খান বলেন, 'তখন আমাদের চরম অভাবে দিন কাটত। এক বেলা রান্না করে তিন বেলা খাইতাম। বেচাকেনা হইতো না। তবুও আমরা দুই ভাই ব্যবসা ছাড়লাম না। কষ্ট কইরা ধইরা থাকতে থাকতে আজ এই অবস্থায় আছি।'
সলপ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালে এক সারিতে চারটা দোকান চোখে পড়বে। মালেক খানের 'সলপ ঘোল ঘর এন্ড সাদেক খান দই ঘর', খালেক খানের 'সলপ দই ঘর', আব্দুর রাজ্জাকের 'সলপ মাঠা-ঘোল-দই ঘর' ও আব্দুল জলিলের 'সলপ স্পেশাল ঘোল ঘর'। সাদেক খানের বংশধরদের দু'টো দোকান। বাকি দুটো অন্যজনের।
সলপের ঘোল-মাঠা যেমন বিখ্যাত দই বা ঘি তেমন বিখ্যাত নয়। তবে স্বাদ, মান ও গন্ধে কোনো অংশে কম নয়। দই-মাঠা-ঘোল-ঘি সব কয়টি আইটেম খুব সাবধানে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়।
দুধের জ্বালটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। দইয়ের জন্য জ্বাল বেশি দিতে হয়। দুধ জ্বাল দিতে দিতে দুধের ওপর যে পাতলা সর জমে সেগুলো সযত্নে তুলে রাখা হয় ঘিয়ের জন্য। ঘোলের দুধ থেকে সর তোলা হলেও দইয়ের দুধ থেকে সর তোলা বারণ।
ঘোলে চর্বি বা ফ্যাটের পরিমাণ সবচেয়ে কম থাকে। সর তোলার পরে আবার জ্বাল দেওয়া হয়। তারপর মেশিনে দুধকে নাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করে ফাটানোর ব্যবস্থার করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় দুধ থেকে মাখন বা ননি বের হয়ে আসে। মাঠা তৈরির সময় ননি বের করা হয় না।
খালেক খানের দোকানের ঘোল ও মাঠার কারিগর সাদ্দাম হোসেন বলেন, 'এক মণ দুধ থেকে ইচ্ছা করলে ১ কেজির বেশি ঘি বের করা যায়। এক কেজি ঘির দাম ৮৫০ টাকা। যেহেতু বের করা হয় না তাই মাঠার দাম কেজিতে ঘোলের চেয়ে ২০ টাকা বেশি রাখা হয়।'
দোকানের পেছনে সারাদিন পণ্যগুলো প্রস্তুত করার মহাযজ্ঞ চলে। খালেক খানের দোকানে মোট ১৮ জন কর্মচারী। মূল কারিগর ৩ জন – হেলাল, সেলিম ও সাইদুল। এরা সবাই খালেক খানের কাছ থেকে দুধের কারিগরি শিখেছেন। পালাক্রমে কাজ চলে।
হেলাল বলেন, 'প্রথমদিকে দুধ জ্বাল দেওয়া, ডেকচি নামানো, ঝাঁপি ঠিক করা, কারখানা ও যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করা ইত্যাদি কাজগুলো যে কাউকে দিয়েই করানো যায়। আমরা যারা মূল কারিগর তারা খেয়াল রাখি সবকিছু যেন পরিমাণমত হয়। কম হলেও হবে না, বেশি হলেও নষ্ট হবে।'
তিনি আরো বলেন, 'দুধের জ্বাল তো দেখা লাগেই। এছাড়াও মাল-মশলা কখন কী পরিমাণ দিতে হবে, মেডিসিন বা কেমিক্যাল (যেমন ; খাবার সোডা, দইয়ের বীজ ইত্যাদি) দেওয়ার দরকার হলে কখন কতটুকু দিতে হবে সেটাও অভিজ্ঞ কাউকে দাঁড়িয়ে থেকে দিতে হয়। সামান্য একটু হেরফের হলেই পুরা পাতিল নষ্ট।'
মালেক খানের ভাইপো ও দোকানের একজন কর্মকর্তা আলামিন খানকে জিজ্ঞাসা করলাম এখনকার সলপের ঘোল কি গুণে-মানে সাদেক খানের ঘোলের মতো আছে?
তিনি নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেন, 'না, গুণে-মানে সাদেক খানের ঘোলের চেয়েও উন্নত হয়েছে।' এ কথা শুনলে যে কেউ আশ্চর্য হবেন। তিনি আমার বিস্ময় দূর করতে দোকানের পেছনের ঘোল-মাঠা তৈরির কারখানায় নিয়ে গেলেন। ঘোল-মাঠা তৈরির পুরনো প্রযুক্তির পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আগেকার দিনে দুধকে মথন করে মাখন বা ননী বের করতে একপ্রকার নাড়ানি বা ঘোটনা ব্যবহার করা হত। দড়ি দিয়ে টেনে নাড়ানিটি চালু রাখা হত। স্থানীয় ভাষায় যন্ত্রটির নাম 'ঘুরুট'।
ঘুরুটের দিন আর নেই। তবুও যন্ত্রটি মালেক খানের দোকানের এক কোণায় পড়ে আছে। ঘুরুটের কাজ এখন বিদ্যুতচালিত যন্ত্র করে। কারিগর সেলিম হক জানান, 'বয়স্ক যে দু'একজন কারিগর আছেন তারা এখনও ঘুরুট টানে। অত ধৈর্য আজকাল সবার হয় না।'
আলামিন খান প্রক্রিয়াজাতকরণের সব ধাপ দেখানোর পরে বললেন, 'আগে মাঠা হত পাতলা। ১ মণ দুধ থেকে দেড় মণের বেশি মাঠা হত। এখন দেড় মণ দুধ থেকে ১ মণের কম ঘোল বা মাঠা হয়। কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়াতেও আধুনিকতার ছাপ লেগেছে। স্বাদ তাই আগের চেয়ে বেড়েছে।'
এ ব্যাপারে খালেক খান আরেকটু যোগ করে বলেন, 'বানানোর প্রক্রিয়া উন্নত হলেও, গরুর দুধের গুণ আগের চেয়ে নষ্ট হয়েছে। গরুকে দেশি ঘাস না খাইয়ে কচুরিপানা খাওয়ানোর জন্যই এই দশা। আগে এক মণ দুধ নাড়ালে আড়াই কেজি বা সোয়া দুই কেজি ঘি বের হত। এখন হয় এক কেজির মতো।'
হাসতে হাসতে তিনি আরো বললেন, 'আমরা অনেক যত্ন করে উন্নত প্রযুক্তিতে প্রোডাক্ট বানাই। তবুও যদি মনে হয় মান কমে গেছে তো তার জন্যে গরু আর গরুর খামারি দায়ী।'
সারাবছর সকাল সাতটায় ঘোলের দোকান চারটি চালু হয়। সন্ধ্যা সাতটার পরে বন্ধ হয়ে যায়। গরম বাড়ার সাথেসাথে সলপে ঘোলের বিক্রি বেড়ে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ঘোল খেতে ও নিতে আসে। শীতের দিনে বিক্রি কমে যায়। মালেক খানের দোকানে শ্যীতের ভেতর প্রতিদিন ১৫-২০ মণ দুধের ঘোল-মাঠা-দই-ঘি উৎপাদন করা হয়। ৪০ কেজিতে এক মণ ধরা হয়।
গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০ মণ দুধের পণ্য উৎপাদিত হয়। রোযার দিনে এই পরিমাণ হু হু করে বেড়ে যায়। তখন প্রতিদিন ১৫০-১৬০ মণ বা ৬০০০ কেজির ঘোল-মাঠা-দই-ঘি উৎপাদিত হয়।
রোযার ভেতর সারা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘোল বিক্রির জন্য এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। এজেন্টদের বেশিরভাগই নিজেরা আসে। তারা খুচরা মূল্যের চেয়ে একটু অল্প দামে ঘোল নিয়ে দোকানের খুচরা দরেই বিক্রি করে। দোকান কর্তৃপক্ষ এদের নাম দিয়েছে 'ব্যাপারী'।
মালেক খানের দোকানের একজন সেলসম্যান রেজাউল করিম বলেন, 'রোযার দিনে, ছুটির দিনে বিক্রি বেশি হয়। রোযার ভেতর দুপুর তিনটা-চারটার ভেতরই সব ঘোল বিক্রি হয়ে যায়। দোকানের কপাট লাগিয়ে রাখতে হয়। জগ, হাড়ি, পাতিল, বোতল, ঢোপ (প্লাস্টিকের বড় পাত্র বিশেষ), জারকিন (ঘোষেরা যে বড় প্লাস্টিকের ঘটে দুধ সংগ্রহ করে) দিয়ে সিরিয়াল দেয় লোকজন। বিরাট সিরিয়াল হয়। ঘোল দিতে পারি না বলে হাতাহাতি হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।'
মালেক খানের ঘোলের একজন নিয়মিত ক্রেতা সাইদুর রহমান বলেন, 'সলপের ঘোল খেতে আসতে হয় গোপনে। যদি কেউ ঘুণাক্ষরে জেনে ফেলে আপনি সলপ খেতে আসতেছেন তখন আর রক্ষা নাই। হয় তাকে সাথে করে নিয়ে আসতে হবে, নাহলে তার জন্য খানিকটা ঘোল নিয়ে যেতে হবে।'
মালেক খান বলেন, 'এখানে সবচেয়ে বেশি ঘোল খেতে আসে তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রীরা। শহরের লোকজন এখানে এসে একটু নিঃশ্বাস নেয়। ছুটির দিনে আমাদের দোকানের ভেতরের হলরুম ও বাইরের চেয়ার-টেবিলেও জায়গা দিতে পারি না। অনেকে পরিবার নিয়ে এসে এক টেবিল একা বুক করে নেন।'
একদল তরুণের সাথে দেখা হল যারা সিরাজগঞ্জ সদর থেকে বাইক রাইডিং করে সলপে এসেছে ঘোল আর মাঠা খেতে। সানী, আইনান, শিশির, বাঁধন, তপুরা জানাল যে তারা সবাই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ। ছুটিতে বাড়িতে আসলেই তারা সাদেক খানের ঘোল খেতে দলবেঁধে সলপ আসে।
বাঁধন বলল, 'এই দোকান কয়েকটা এমন একটা জায়গায় যেখানে আসতে চাইলে গ্রামের অপরূপ প্রকৃতির ভেতর দিয়ে আসতে হয়। মাঠ-ঘাট-বাঁধ-সেতু-মোড় পেরিয়ে তারপর সলপ স্টেশন বাজার। এ কারণেও অনেকে সলপে আসে।'
এনজিও কর্মী বুলবুল আহমেদ উল্লাপাড়া সদরে চাকরি করেন। তিনি বললেন যে, তাকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার সলপ আসতে হয়। এমন কোনো সপ্তাহ তার মনে নেই যেবার সলপে এসেছিলেন কিন্তু ঘোল নিয়ে যাননি। তার পরিবারের সবাই সলপের ঘোল খেতে ভীষণ পছন্দ করে।
খালেক খানের কাছে দোকানের বিক্রি-বাট্টার ব্যপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, 'আমার আর ভাইয়ের (মালেক খান) বিক্রি প্রায় সমানই। আমরা শুরু থেকে একসাথেই ছিলাম। ৬-৭ বছর আগে আলাদা হইছি। আমি আমার চাচার দোকানটা কিনে নিয়ে ভাগ হয়ে গেছিলাম।'
খালেক খান জানালেন যে সলপের স্পেশাল মাঠা তার আবিষ্কার। এক যুগ আগেও সলপে মাঠা বানানো হত না। একবার পার্শ্ববর্তী শাহজাদপুরের এক ব্যক্তি ছোট এক বোতলে মাঠা এনে তাকে বললেন যে কয়েক কেজি মাঠা বানিয়ে দিতে হবে। খান খেয়ে বললেন যে এই কটু স্বাদের মাঠা বানানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রচলিত মাঠা সাধারণত লবণাক্ত ও টক স্বাদের হয়ে থাকে। ঘোলের কাঁচামালের ভেতর পুদিনা, লবঙ্গ, রসুন, জিরা, লেবু, ধনেপাতা ইত্যাদি দিয়ে বানানো হয়। লোকটির পীড়াপীড়িতে খালেক খান ঘোলের কাঁচামাল দিয়ে মাঠা বানানোর চেষ্টা করলেন। বানানোর এক পর্যায়ে এর ভেতর চিনি দেওয়া হল। ননি খানিকটা বেশি রাখা হল।
খালেক খানের বানানো মাঠা খেয়ে শেষে লোকটির চক্ষু চড়কগাছ। দৈবভাবে নতুন স্বাদের মাঠার আবিষ্কার হল। সেই থেকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সলপে মাঠার প্রচলন।
চারটি দোকানেই সমান তালে ঘোল-মাঠা-ঘি-দই বানানো হলেও অনেক খরিদ্দার মনে করেন খালেক-মালেক ভাইদ্বয়ের ঘোল বেশি সুস্বাদু।
'সলপ স্পেশাল ঘোল ঘর'-এর মালিক আব্দুল জলিল খালেক খানের ভগ্নিপতি। খালেক খানের দোকানে তিনি প্রায় ৯-১০ বছর কাজ করেছেন। খালেক-মালেকের কাছে দইয়ের কারিগরি শিখেছেন। ২০১৯ সালের দিকে তিনি আলাদা দোকান দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে খালেক খান তাকে অর্থ, কারিগরি যন্ত্রপাতি ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন।
আব্দুল জলিল সরাসরি তার সমন্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তার ঘোল আসল কিনা এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আমি নিজ হাতে খালেক ভাইয়ের দোকানে শত শত মণ ঘোল তৈরি করছি। আমার ঘোল খেয়ে তখন মানুষ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বাড়ি ফিরত। বলত 'সলপের আসল ঘোল'। এখন নিজের দোকানে ঘোল বানিয়ে বেচি। সেই মানুষরাই বলে আমার ঘোল নকল। স্বাদ নাই। তাহলে কি বোঝা গেল? আসল-নকল মানুষের মনে।'
আব্দুল জলিলের দোকানের বিক্রির পরিমাণ খালেক-মালেকের দোকানের মত অত বেশি নয়। পুরো গরমকালে প্রতিদিন তার দোকানে প্রায় দশ জারকিন দুধের ঘোল উৎপাদন করা হয়। ঘোষদের কাছে ৫৫ কেজি মাপের যে বড় প্লাস্টিকের ব্যারেলের মতো পাত্র থাকে তাকে জারকিন বলা হয়। দশ জারকিন মানে ৫৫০ কেজি বা ১৩-১৪ মণ।
আব্দুল জলিলের দোকানটি তার ছেলে আসিফ হোসেন এবং ভাইপো সাজু ইসলাম দেখাশোনা করেন। তিনি তাদের দুধের কারিগরি শেখাচ্ছেন। তারা অনেকটাই শিখে উঠেছে।
উল্লাপাড়া এইচ টি ইমাম ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী তামান্না ও মিম পরিবারের সাথে সলপ ঘোল খেতে এসেছিলেন । তারা বলেন, 'সলপের নকল ঘোলও খুব টেস্টি। আমরা খাবো এবং তারপর সাথে কিছু নিয়ে যাবো।'
আবুল জলিলের মতো আব্দুর রাজ্জাকও দীর্ঘদিন দুধ ও দইয়ের ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি খালেক-মালেকের কাছ থেকে ঘোল-দই কিনে জেলার বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করতেন। একসময় তার মনে হল নিজেরই দোকান দিয়ে বসা উচিত। তিনি ছেলেদের নিয়ে খালেক খানের দোকানের পাশেই দোকান শুরু করলেন।
ছয় ছেলেকে সাথে নিয়ে আব্দুর রাজ্জাক দোকান পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, 'আমি জীবনে অনেকরকম ব্যবসা করছি। তাঁতের কাপড়ের ব্যবসাও করলাম। সবশেষে এই ঘোলের বিজনেস ধরলাম। ঘোল বানানোর বিদ্যায় আমি নিজে এখনও পাকাপোক্ত হই নাই পুরাপুরি। আমার কারিগর রাখা আছে। সে খুব ভালো ঘোল ও মিষ্টি বানায়।'
বিক্রির পরিমাণ আব্দুর রাজ্জাকের দোকানেও কম হয় না। প্রতিদিন গড়পড়তা ৮-১০ মণ দুধের পণ্য তৈরি করা হয়।
খালেক খান বলেন, 'অনেক কাস্টমার প্রথমে এসে বুঝতে পারে না কোনটা ঘোলের মূল দোকান। তারা যখন ঐ দোকানগুলো ঘুরে তারপর আমাদের এখানে এসে হাকাহাকি করেন তখন আমরা তাদের এক গ্লাস ঘোল এগিয়ে দিয়ে বলি এইটা খেয়ে বলেন কোনটা আসল। তারা খায়। খাওয়ার পরে প্রশংসা করে। আমাদের ভালো লাগে।'
সলপের ঘোলের দেশব্যাপী বিখ্যাত হওয়ার পেছনে সিরাজগঞ্জের প্রভাতী সংঘের অবদান কম নয়। তারা বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সলপ স্টেশন চত্ত্বরে ঘোল উৎসবের আয়োজন করে আসছে।
প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম শুক্রবার ঘটা করে প্যান্ডেল সাজিয়ে ঘোল উৎসব পালন করা হয়। পুরো জেলা থেকে কয়েকশ' সচেতন নাগরিক এ উৎসবে অংশ নেন। সদস্যরাই কমবেশি ব্যয়ভার বহন করেন। সেদিন সলপ স্টেশন অন্যরকম রূপ ধারণ করে। ঘোলের দোকানগুলো স্পেশাল দই-চিড়া, ঘোল-চিড়ার আয়োজন করে।
কিছুদিন ধরে ঘোলের দোকানক'টিতে নিয়মিত সকাল-বিকালের নাস্তা হিসেবে ঘোল-মাঠার সাথে চিড়া, মুড়ি, মুড়কি বিক্রি করা শুরু হয়েছে। প্রতি গ্লাস ঘোল ১৫ টাকা, মাঠা ২০ টাকা। এর সাথে কিছু চিড়া, মুড়ি-মুড়কি মিশিয়ে ভিজিয়ে প্লেটে পরিবেশন করা হয়। দাম ২৫-৩০ টাকা। স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এটি সবচেয়ে বেশি খায়।
সলপ থেকে সারাদেশে ঘোল পাঠানো হয়। কুরিয়ারের চেয়ে বাসের ডিপোতে বেশি ঘোল যায়। ইদানীং বিশেষ মাপের বোতলে খান ভাইয়েরা ঘোল সাপ্লাই দেওয়া শুরু করেছে। ঘোলের প্রি-অর্ডারও নেওয়া হয়। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে দই-ঘোলের অর্ডার নেওয়া হয়।
ঘোল বা মাঠার পেটেন্ট করার ব্যপারে খালেক খানকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি মুচকি হেসে বললেন, 'নামের আগে সলপ না দিলে কেউ তার দোকানে ঘোল কিনতে যায় না। পেটেন্ট করে আমরা তাদের পেটে লাথি মারতে চাই না। এই অজপাড়া গাঁয়ে সবাই সবার মতো ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাক।'
চলে আসার আগে আলামিন খানকে আবার প্রশ্ন করলাম যে সলপের ঘোলের স্পেশালিটি ঠিক কোন জায়গায়? তিনি আরেক গ্লাস ঘোল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন 'আপনিই বলেন কোন জায়গায় স্পেশাল।'