দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বেড়েছে, খামারিদের খরচ বাড়লেও বাড়েনি দুধের দাম
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের দুগ্ধ খামারি আব্দুর রাজ্জাক। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তার আয় বাড়েনি, কিন্তু খামার পরিচালনার খরচ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
রাজ্জাক জানান, এক বছর আগেও প্রতি লিটার দুধ ব্র্যাক, প্রাণের মতো কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে ৪৫-৪৯ টাকা পেতেন, এখনও তা-ই পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, খরচ বাড়া সত্ত্বেও খামার পর্যায়ে দুধের দাম সেই অনুপাতে বাড়েনি। এর ফলে অনেক খামারি দুধ উৎপাদন ছেড়ে দিতে বা কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, অথবা গাভির সংখ্যা কমিয়ে আনছেন।
একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন সিরাজগঞ্জ ও পাবনার অন্যান্য কৃষকেরাও। তাদের দাবি, বড় বড় দুধে কোম্পানিগুলো খামারি পর্যায়ে দুধের দাম বাড়াচ্ছে না। বরং এসব কোম্পানি প্রক্রিয়াজাত দুধ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।
খামারিরা বলছেন, খামারি পর্যায়ে এই খরচ বৃদ্ধিকে সামনে রেখে প্রতি লিটার পাস্তুরিত দুধের দাম ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে কোম্পানিভেদে ৯০-৯৫ টাকা করা হয়েছে। এর আগের বছরের (২০২২ সালে) মাঝামাঝিতেও একবার দুধের দাম লিটারে ১০ টাকা বাড়ায় কোম্পানিগুলো। অথচ খামারি পর্যায়ে দুধের দাম দুই বছর ধরে প্রায় একই রয়েছে।
কোম্পানিগুলো যে শুধু দুধের দাম বাড়িয়েছে তা নয়। দুগ্ধজাত যত পণ্য আছে সবগুলোর দামই বাড়ানো হয়েছে। আধলিটার মিষ্টি দইয়ের দাম এখন ১২০ টাকা, যা ২০২১ সালেও ছিল ৮০ টাকা। ২০১৮ সালে এই দাম ছিল ৬৫ টাকা। ২০১৮ সালে ৯০০ গ্রাম ওজনের এক কৌটা ঘি বিক্রি হয়েছে কোম্পানিভেদে ১ হাজার ২০ থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায়। এখন এই ঘিয়ের দাম এখন ১ হাজার ৪২০ টাকা।
মিষ্টি, আইসক্রিম, বাটার, লাবাং, ফ্লেভারড মিল্কসহ দুগ্ধজাত যত পণ্য রয়েছে, সবগুলোই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দাম দিয়ে। কিন্তু গত দুই বছর ধরে শুধু আটকে আছে খামারি পর্যায়ে দুধের দাম।
খামারিরা জানান, দুধ কোম্পানিগুলো খামার পর্যায়ে দুধের দাম সাময়িকভাবে ১.৫-৫ টাকা বাড়ালেও কিছুদিন পরই আবার তা কমিয়ে দেয়।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মার্কেটিং ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল বলেন, 'ইন্ডাস্ট্রি পর্যায়ে গত দুই বছরে আমাদের প্রায় ২০ শতাংশের মতো খরচ বেড়েছে। আমরা গত বছর যেটুকু দাম বাড়িয়েছি, তা কমাইনি। কখনও কখনও ৭-৭০ দিনের জন্য খামারিদের ইনসেনটিভ দেওয়া হয় তাদেরকে উৎসাহ দেয়ার জন্য। সেটা আবার নির্দিষ্ট সময় পরই বাতিল করা হয়।'
তিনি বলেন, 'আমরা খামারিদের উদ্বুদ্ধ করতে, তাদের সহায়তা দিতে অনেক কাজ করি। গরু কেনায় ব্যাংক গ্যারান্টর হওয়া এবং ন্যায্যমূল্যে সিমেন, মেডিসিনসহ নানা ধরনের সহায়তা করা হয়। এছাড়া উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য খামারিদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।'
কোম্পানিগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনে মূলত ফ্যাটের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। খামারিদের উৎপাদিত দুধে ৩.৫-৭ শতাংশ পর্যন্ত ফ্যাট পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুধে ৪-৫ শতাংশ ফ্যাট পাওয়া যায়।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার বলেন, কোম্পানিগুলো ফ্যাটের ওপর নির্ভর করে গড়ে ৪৫ থেকে ৫২ টাকায় প্রতি লিটার দুধ কেনে।
'যেভাবে গোখাদ্যের দাম বেড়েছে, তাতে এই দামে কোম্পানির কাছে দুধ বিক্রি করে খামারিদের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে,' বলেন তিনি।
বেড়েছে খামারিদের খরচ
খামারিরা বলছেন, মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই খৈল, ভুষির মতো গোখাদ্য এবং ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে। এর মধ্যে খৈলের দাম ৩৭-৩৮ টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৫৩ টাকা, ভুষির দাম ৪০-৪১ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮-৪৯ টাকা হয়েছে। ক্যালসিয়ামের মতো নিয়মিত ওষুধের দাম (প্রায় প্রতি মাসেই কিনতে হয় খামারিদের) প্রতি লিটার ১৪০-১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকা হয়েছে।
পাবনার ভাঙ্গুরা থানার খামারি মো. খোকন বিশ্বাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রতিদিন আমি ৬০০ লিটারের মতো দুধ কোম্পানির কাছে বিক্রি করি। ৪.৫ শতাংশ ফ্যাট থাকলে তার দাম ৪৫ টাকা, ফ্যাটের পরিমাণের ওপর দামও ওঠানামা করে। দুই বছর আগেও এরকমই ছিল। এক বছরে দু-তিনবার যেটুকু দাম বাড়ানো হয়েছিল তা আবার ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই কমিয়ে দিয়েছে।'
তিনি বলেন, '১ হাজার ৬৫০ টাকায় যে ভুষির বস্তা (৪৩ কেজি) কিনতাম, সেটা এখন কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৩২০ টাকায়। আর ভুষির ৩৭ কেজির বস্তার দাম ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৮০০ টাকা হয়েছে।'
খামারিরা জানান, গত পাঁচ বছরে গোখাদ্যের দাম দ্বিগুণ বাড়লেও খামার পর্যায়ে লিটারপ্রতি দুধের দাম বেড়েছে মাত্র ১০ টাকা, আর শেষ দুই বছরে বৃদ্ধির হার শূন্য পর্যায়ে।
শাহজাদপুরের দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি শহিদ আলী বলেন, এখন সকালে লিটারপ্রতি দুধের দাম দিচ্ছে ৪৩ টাকা আর বিকেলে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকায় দুধের দাম দেয় ৪৯-৫০ টাকা লিটার। ঠিক ৫ বছর আগে সকালে লিটারপ্রতি দুধের দাম দিত ৩৬ টাকা এবং বিকেলের দুধে দাম পাওয়া যেত ৪১ টাকার মধ্যে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে দুগ্ধ খামারি আছেন প্রায় ৩০ হাজার। প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হয় ৫ লাখ লিটার। বড় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি ও ছোট দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি মিলে প্রতিদিন খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে সাড়ে ৩ লাখ লিটার। বড় কোম্পানির মধ্যে মিল্কভিটা, আড়ং, প্রাণ, ইগলু ও আকিজের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র রয়েছে শাহজাদপুরে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে দুগ্ধ খামারির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ২০২২-২৩ বছরে ১.৪০ কোটি টন দুধ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম সারির দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো ৭-৮ লাখ টন দুধ প্রক্রিয়াজাত করে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত করছে।
বাকি দুধ খামারিরা মিষ্টির দোকান, খোলাবাজারে বিক্রি করছেন। খোলাবাজারে বিভিন্ন সময়ে প্রতি লিটার দুধ ৬০ থেকে ৭৫ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয় বলে জানান খামারিরা। প্রতিনিয়ত চাহিদার ওঠানামার কারণে বড় খামারিরা তাদের উৎপাদিত দুধ খোলাবাজারে সবসময় বিক্রি করতে পারেন না বলে বাধ্য হয়েই প্রসেসর কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. এমদাদুল হক তালুকদার টিবিএসকে বলেন, 'খামারিদের মধ্যে এখন আমরা খাদ্য হিসেবে ঘাসের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য বলছি। এজন্য সারা দেশে ঘাসের চাষও বেড়ে যাচ্ছে। আর যারা ঘাসের ওপর নির্ভরশীল, তারা লাভে থাকছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা এলডিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে মিল্ক কালেকশন সেন্টার, প্রসেসিং জোন তৈরি করছি। এগুলো হয়ে গেলে কোম্পানিগুলোর একক কর্তৃত্ব কমে যাবে এবং তখন খামারিরা ভালো দাম পাবেন। এর মাধ্যমে পুরো সাপ্লাই চেইনের আধুনিকায়ন করা হচ্ছে।'