শিক্ষার চেয়ে চিকিৎসার পেছনেই বেশি খরচ হচ্ছে পরিবারগুলোর
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, স্বাস্থ্য খাতে ক্রমবর্ধমান বাড়তি ব্যয় দেশের পরিবারগুলোকে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখে ফেলে দিয়েছে। গত কয়েক বছরে চিকিৎসা খাতে ব্যয় বেড়েছে ২০২ শতাংশ। ফলে পারিবারিক ব্যয় অগ্রাধিকারে শিক্ষাকে ছাড়িয়ে গেছে স্বাস্থ্য খাত।
বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষায় প্রতি এক টাকা ব্যয়ের বিপরীতে পরিবারগুলোর স্বাস্থ্য ব্যয় ২০২২ সালে ৩.৬৬ টাকায় উঠেছে, যা ২০১৭ সালে ছিল মাত্র ০.৮৪ টাকা।
এ সময়ে পরিবারগুলোর সামগ্রিক ব্যয় গড়ে ৯৮ শতাংশ বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বেড়েছে ২০২ শতাংশ। বিপরীতে একই সময়ে শিক্ষায় গড় ব্যয় কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশ।
ব্যয়ের ধরন যেভাবে বদলে গেল
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রকাশিত বিবিএস জরিপের তথ্য বলছে, শিক্ষায় পরিবারগুলোর মাসিক গড় ব্যয় ৫৭৮ টাকায় নেমে এসেছে, যা মাসিক সামগ্রিক গড় ব্যয়ের মাত্র ১.৮৯ শতাংশ। ২০১৭ সালে পরিবারগুলো শিক্ষায় গড়ে ৮৩৬ টাকা বা পরিবারের সামগ্রিক ব্যয়ের ৫.৪২ শতাংশ ব্যয় করত।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য পরিষেবায় গড়ে মাসিক পারিবারিক ব্যয় ২০১৭ সালের ৭০০ টাকা থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ২ হাজার ১১৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। মোট ব্যয়ের মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যয়ের অংশ ৪.৫৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৯১ শতাংশে।
জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা-সংক্রান্ত পণ্য ও সেবার দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির কারণে স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে। তাছাড়া কোভিড-পরবর্তী সময়ে উদ্ভূত বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় চিকিৎসার বাড়তি চাহিদাও এ খাতের ব্যয় উসকে দিয়েছে।
শিক্ষায় ব্যয় হ্রাসের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করে তারা বলেন, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ বাড়বে। পাশাপাশি শিক্ষার মানে অবনতির কারণে দীর্ঘমেয়াদে জনশক্তির দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতাও কমে আসতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অভ হেলথ ইকোনমিক্স-এর অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়লে ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে থাকলে শিক্ষায় সাধারণত পরিবারের ব্যয় কমে আসে।
জরুরী প্রয়োজন বিবেচনায় পরিবারগুলো স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়কেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে মন্তব্য করে ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন-এর নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সংকটকালে শিক্ষায় ব্যয়ের বিষয়টি 'পরবর্তীতে বিবেচ্য বিষয়' হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থনৈতিক চাপ ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা
অর্থনৈতিক চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে পারিবারিক পর্যায়ে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে বলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, প্রায় ৩৭ শতাংশ পরিবার তাদের সংসার চালানোর জন্য ধার করছে। প্রতিটি পরিবারে গড়ে ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা ঋণ রয়েছে। ঋণগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ও ঋণের পরিমাণ গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে ১.১৩ শতাংশ মানুষ। আর মাঝারি ও গুরুতর পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে ২১.১১ শতাংশ মানুষ।
যেসব কারণে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়
গত কয়েক মাসে সব ধরনের চিকিৎসা উপকরণ ও সেবার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ।
তিনি বলেন, ওষুধের দাম, হাসপাতালে ভর্তি ফি এবং সিট ও কেবিনের ভাড়া, ডাক্তারের ভিজিটসহ সব খরচ বেড়েছে।
তাছাড়া সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে কোভিড-পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা যেমন বেড়েছে, তেমনি এই মহামারিতে সৃষ্ট নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার কারণেও চিকিৎসার চাহিদা বেড়েছে।
অধ্যাপক হামিদ বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই প্রতি বছর দেশের জনগণ নিজেদের পকেট থেকে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকার বেশি চিকিৎসায় ব্যয় করেন। সরকারের বিনিয়োগ কম থাকায় স্বাস্থ্য খাতে মানুষের 'আউট অভ পকেট' ব্যয় বেড়েই চলেছে।
বিবিএসের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, রোগীপ্রতি বাংলাদেশে চিকিৎসায় গড়ে ১ হাজার ৩৭৭ টাকা করে ব্যয় হচ্ছে। এর মধ্যে ডাক্তারের ভিজিটে ১৪২ টাকা, ওষুধে ৭৪৯ টাকা, টেস্টের ফি বাবদ ৩৭৯ টাকা এবং পরিবহনে ১০৭ টাকা করে ব্যয় করছেন রোগীরা।
ওষুধ কিনতে চিকিৎসার মোট ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ হলেও বিনামূল্যে সরকারি ব্যবস্থা এবং এনজিও থেকে ওষুধ পাওয়ার সুযোগ কমে গেছে। এর ফলে আগের চাইতে বেশিসংখ্যক মানুষ বেসরকারি ফার্মেসি ও ডিসপেন্সারি থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছে।
অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ কমে আসায় বেসরকারি ক্লিনিক এবং হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। ২০১৫ সালে ৮.৬১ শতাংশ মানুষ বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিত, ২০২২ সালে তা বেড়ে ৯.১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অধ্যাপক হামিদ পরিবারের ওপর চাপ কমাতে স্বাস্থ্য ও এর গুণগত মানের ওপর সরকারি ব্যয় বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জিডিপির ১ শতাংশেরও কমে স্থবির রয়েছে। এ কারণেই জনগণ নিজেদের পকেট থেকে সরকারি বরাদ্দের চারগুণের বেশি ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে।
২০১৮ সালে করা নিজের এক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরগুলোতে লোকজনের ভ্রমণে যে ভাড়া ও সময় ব্যয় হয়, তার আর্থিক মূল্য ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকারি চিকিৎসাসেবার বিকেন্দ্রীকরণ স্বাস্থ্য পরিষেবায় এই ব্যয়ের বড় একটা অংশ কমাতে সাহায্য করবে বলেও তিনি মনে করেন।
শিক্ষার খরচ কি সত্যিই কমেছে?
'২০১৯ সালে ২০ টাকায় বিক্রি হওয়া নোটবুকের দাম এখন ২৫ টাকা, ২৫ টাকায় বিক্রি হওয়া এক দিস্তা সাদা কাগজের দাম এখন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। ৫৫০ টাকার রঙিন পেন্সিল বক্সের দাম ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকায়,' রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীর অভিভাবক সাবিনা ইয়াসমিন এভাবেই সন্তানের শিক্ষা ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিবরণ দিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে পরিবহন খরচ, স্কুল ব্যাগ, পানির বোতল, ইউনিফর্ম, ইরেজার এবং টিফিনের দাম বেড়েছে।
বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধির প্রবণতার প্রতিফলন পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনটিতেও রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় ৯০০ টাকা থেকে ৯৪ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৭৪৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। পল্লি এলাকায় প্রতি শিক্ষার্থীর ১ হাজার ১৭১ টাকা ব্যয়ের বিপরীতে নগর অঞ্চলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাসে ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৯২৭ টাকা করে।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত স্কুলে শিক্ষার সুযোগ কমে আসায় বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে বেসরকারি স্কুলে শিক্ষা নেওয়ার হার ২০১৭ সালের ৪.৬০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৭.৬৫ শতাংশে উঠে এসেছে।
শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় দ্বিগুণ হলেও পরিবারপ্রতি মাসিক গড় শিক্ষা ব্যয় ২০১৭ সালের ৮৩৬ টাকা থেকে কমে ২০২২ সালে ৫৭৮ টাকায় ঠেকেছে বলে উঠে এসেছে বিবিএসের প্রতিবেদনে।
শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু গড় শিক্ষা ব্যয় বাড়লেও পরিবারপ্রতি শিক্ষা ব্যয় কমার পেছনে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সংযোগ রয়েছে বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধুরী।
খাদ্য নিরাপত্তার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে শিক্ষায় বরাদ্দ কমাতে দেখা যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'হাজিরা খাতায় অনেক শিক্ষার্থীর নাম থাকলেও সরেজমিন পরিদর্শনে তাদের শ্রেণিকক্ষে পাওয়া যায় না। জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের কারণে তাদের অনেকেই হয়তো শিশুশ্রমে যোগ দিয়েছে বা মেয়েশিশু হলে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।'
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের প্রতিবেদনের উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি রয়েছে এমন শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে। শিক্ষার খরচ বহন করতে না পারায় পরিবারগুলো তাদের মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান শিশুশ্রমের বিষয়টিকে তিনি পারিবারিক পর্যায়ে আর্থিক চাপের আরেকটি লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিবিএসের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, পরিবারগুলোর আয়, ব্যয় এবং জীবনযাত্রার মানের তথ্য তুলে ধরতে পল্লি ও শহর অঞ্চল থেকে সমান হারে মোট ১৪ হাজার ৪০০টি নমুনা পরিবারের ওপর এই জরিপ চালানো হয়েছে।
জরিপে পাওয়া বিভিন্ন সূচকে পরিবর্তনের কারণ খুঁজে বের করতে হলে আরও ব্যাপক আকারের গবেষণার প্রয়োজন হবে বলেও তারা মন্তব্য করেন।
শিক্ষা ব্যয়ে সংকোচনের পরিণতি ও তা এড়ানোর উপায়
দেশবাসীর গড় আয় বৃদ্ধি, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পর ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্বে ছাড়ের অবসানের কারণে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আগামীতে চিকিৎসার ব্যয় আরও বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এর ফলে শিক্ষার ব্যয় মেটানো পরিবারগুলোর জন্য আরও চ্যালেঞ্জিং হবে বলে সতর্ক করে শিক্ষা ও চিকিৎসায় সরকারি ব্যয় আরও বাড়ানোর তাগিদ দেন তারা।
এ বিষয়ে সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়ে বা সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা ব্যয় বহন করে। এমনকি নিয়মিত আয়ে চিকিৎসার ব্যয় বহন করে, এমন পরিবারগুলোও খাদ্য ও শিক্ষায় ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়। এর ফলে মানবসম্পদের পুষ্টির ঘাটতির পাশাপাশি দক্ষতার বিকাশও ব্যাহত হয়।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের পরিবারগুলো মোট শিক্ষা ব্যয়ের প্রায় ৭১ শতাংশ বহন করতে বাধ্য হয়। অবকাঠামো ও অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারের ব্যয় বাড়ছে না।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষায় সরকারি পর্যায়ের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবায়নে বড় ব্যবধানের কারণে দক্ষতা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি প্রতিশ্রুত ফলাফলও বিচ্যুত হয়।
'আমাদের এখান থেকে অদক্ষ ও আধাদক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। অন্যদিকে স্থানীয় শিল্পগুলো ম্যানেজমেন্ট লেভেলের পদে বিদেশ থেকে লোকবল নিয়োগ করছে,' মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই পরিস্থিতির অবসান করতে বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়ন করে দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।