শীতের প্রকোপে হাসপাতালে বেড়েছে নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও পোড়া রোগীর ভীড়
তীব্র শীতের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদাহসহ দেশের বেশকিছু এলাকায় গতকাল (বৃহস্পতিবার) বৃষ্টি হয়েছে। কিশোরগঞ্জ, নওগা ও রংপুর বিভাগের ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই সারাদেশে শীতের প্রকোপ বাড়ছে। আর শীতের এই তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও।
নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্দ্রের সংক্রমণ, ডায়রিয়া, পোড়া রোগীসহ শীতকালীন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে রোগীরা। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বয়স্কের হার বেশি। শীতে সবাইকে গরম কাপড় পরা ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশনস সেন্টার এন্ড কন্ট্রোল রুম অফ ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ হেলথ সার্ভিসেস (ডিজিএইচএস) এর তথ্যমতে, গত ২৪ ঘন্টায় বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত সারাদেশে শীতকালীন রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩৬০২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হয় ১১২৬ জন। ভাইরাল ডায়রিয়াজনিত কারণে ভর্তি হয় দুই হাজার ২৪৭৬ জন। আর এই সময় শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ১ জন মারা গেছেন।
ডিজিএইচএস এর তথ্যমতে, গত দুই মাসে দেশে শীতকালীন রোগে আক্রান্ত হয়ে ২ লাখ ৫২ হাজারের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৬৩ জন।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল এন্ড ইন্সটিটিউট এ নিউমোনিয়া নিয়ে শিশুরা বেশি ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালটির ১৯ বেডের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে গতকাল পর্যন্ত কোন বেড খালি ছিলোনা। বাধ্য হয়ে নিউমোনিয়া রোগীদের অন্যান্য ওয়ার্ডে ভর্তি করা হচ্ছে।
বর্তমানে হাসপাতালটিতে ১০৯ জন নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে ১৭ জন। ঢাকার বাইরে থেকে সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকা রোগীরা ঢাকায় আসছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডিরেক্টর প্রফেসর মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "এখন প্রতিদিন গড়ে ১০০০ এর বেশি রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়া নিয়ে রোগীরা আসছে বেশি। শীতে শিশুকে নিউমোনিয়া থেকে রক্ষা করতে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে। ৬ মাসের কম বয়সী শিশুকে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। শিশুর শ্বাস নেয়ার হার ভালো ভাবে গুণতে হবে অভিভাবকদের।"
এদিকে হাসপাতালগুলোতে পোড়া রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকেরা।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের রেসিডেন্ট সার্জন ডাঃ তরিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের হাসপাতালে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ রোগী হওয়ায় এখন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট ও আমাদের ইনস্টিটিউট এক সাথে রোগী সামলাচ্ছি। আমাদের এখানে জায়গার অভাবে যাদের ভর্তি করতে পারছিনা তাদের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হচ্ছে। আগুনে পোড়া, গরম পানিতে পোড়া রোগী অনেক বেড়ে গেছে। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি।"
তিনি আরো বলেন, "শিশুদের আগুন থেকে সুরক্ষিত রাখতে অভিভাবদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া গরম পানি পাতিলে করে না নিয়ে বালতিতে ঢেলে আনা নেওয়া করতে হবে। কারণ পাতিলে বহন করার করার সময় পড়ে গিয়ে শিশু ও নারীরা বেশি দগ্ধ হচ্ছে। এছাড়া যতটা সম্ভব গরম কাপড় পড়তে হবে এবং চুলা, খড়কুটো দিয়ে আগুন তাপানো থেকে বিরত থাকতে হবে।"
এক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে থেকে মেজর বার্ন নিয়ে রোগীরা ঢাকায় আসছে বলে জানান ডাঃ তারিকুল ইসলাম।
আবহাওয়াবিদেরা জানান, এ বছর শীতের শুরুতে শীতের প্রকোপ একেবারে ছিলোনা। হঠাৎ করে আবহাওয়ার তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৬-১৭ ডিগ্রিতে নেমে আসে। বর্তমানে তাপমাত্রা ১০-১৭ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে। এতে শীতের সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে মানুষের।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ডা. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক টিবিএসকে বলেন, "এল নিনোর প্রভাবের কারণেই এবারে বলা হচ্ছে শীতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি থাকতে পারে।"
বায়ু দূষণের কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার সারাদেশেই বেশি কুয়াশা দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ধূলিকণাময় এই কুয়াশার কারণে ফুসফুসের সমস্যা ও এলার্জিজনিত রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকেরা। এসময় গরম কাপড় পরার পাশাপাশি কুয়াশায় মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট ডাঃ এম মুশতাক হোসেন টিবিএসকে বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র হওয়ায় শীত মোকাবেলার প্রস্তুতি নেই। সে কারণে এ সময় রোটা ভাইরাস, নিউমোনিয়া, পোড়া রোগী বেড়ে যায়। কয়েক বছর শীত কম ছিলো, এ বছর সে তুলনায় শীত কিছুটা বেশি। প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নিতে স্বাস্থ্য সেক্টর ও অর্থনীতিতে প্রস্তুতি রাখতে হবে। প্রকৃতির কারণে এখন ডিজিজ প্যাটার্ন বদলে যাচ্ছে। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ অর্জনের জন্য ভালোভাবে কাজ করতে হবে।