চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ অনেকটা স্বাভাবিক, শিল্প কারখানা এখনও বন্ধ
প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনালে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। তবে প্রায় ১২ ঘণ্টা পর গ্যাস সরবরাহ শুরু হলেও চাপ একেবারে কম ছিল। ধীরে ধীরে চাপ বাড়ছে। বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে গ্যাসের চাপ পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ভারী শিল্পকারখানাগুলোকে বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ তদারকি করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। গ্যাসের সরবরাহের জন্য তারা পুরোপুরি নির্ভর করে আমদানিকৃত এলএনজির ওপর। চট্টগ্রামে আগে গ্যাস সংকট হলে সিলেট এবং কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাস আনা হতো আশুগঞ্জ বাখরাবাদ পাইপলাইন দিয়ে। কিন্তু এলএনজি আমদানি শুরু করার পর আশুগঞ্জ বাখরাবাদ পাইপ লাইনকে বাল্ব লাগিয়ে ওয়ান-ওয়ে করে ফেলা হয়। ফলে চট্টগ্রাম থেকে গ্যাস শুধু নেওয়া যায়, আনা যায় না।
কেজিডিসিএলের কর্মকর্তারা জানান, কক্সবাজারের মহেশখালীতে সাগরের তলদেশের সঞ্চালন পাইপলাইনের মাধ্যমে এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। দুটি টার্মিনালের মধ্যে একটির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল গত নভেম্বর থেকে। একটি টার্মিনাল থেকেই এতদিন সরবরাহ চলছিল। বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) রক্ষণাবেক্ষণ শেষ হওয়া টার্মিনালটি কমিশনিং করা হয়েছে। পাশাপাশি অপরটি খালি করা হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। কিন্তু মধ্যরাত থেকে নতুন কমিশনিং করা টার্মিনালটি বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য পুরোপুরি গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আমিনুর রহমান শনিবার বিকালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা বর্তমানে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কম-বেশি গ্যাস পাচ্ছি। বর্তমানে সর্বোচ্চ ১২০-১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস টানা সম্ভব। তাই ভারী শিল্প কারখানাগুলো উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। পুরোপুরি চাপ বাড়তে আরো ৪-৫ দিন সময় লাগতে পারে।'
কেজিডিসিএলের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে দৈনিক ৩১২ মিলিয়ন থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চাহিদা রয়েছে। চট্টগ্রামের দুটি সার কারখানায় দেওয়া হয় ৯০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট, বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং সিএনজি ফিলিং স্টেশনে ১৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বাকি গ্যাস দেওয়া হয় আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহককে। চট্টগ্রামে কেজিডিসিএলের গ্রাহক সংযোগ ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪টি। গৃহস্থালি ছাড়াও এরমধ্যে ইস্পাত, কাচ, সিমেন্ট, শিপ ব্রেকিং, ঢেউটিন, গার্মেন্টসের মতো ভারী শিল্প খাতেও সংযোগ রয়েছে।
স্বাভাবিক সময়ে মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল থেকে ২৮০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায়। গত নভেম্বর থেকে একটি টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করায় ৭০-১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম পাওয়া যাচ্ছিল। এ কারণে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলসহ বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কারখানার মালিকেরা উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ।
দুটি পাইপলাইন দিয়ে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিত না হলে আগামী মার্চ বা এপ্রিলের আগে গ্যাস-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ থাকলেও জানুয়ারিতে এই সরবরাহ প্রায় ৪০ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এখন গ্যাসের সরবরাহ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। এলএনজি আমদানি করতে হয় স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে। ডলার সংকটের কারণে এই মুহূর্তে এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম। কিন্তু এখন এলএনজি টার্মিনালে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে
এদিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় শুক্রবার সকাল থেকে খাবার সংকট দেখা দিয়েছিল গোটা চট্টগ্রামজুড়ে। বাসাবাড়িতে সন্ধ্যা পর্যন্ত চুলা জ্বলেনি। জ্বালানি গ্যাসনির্ভর পরিবহনও সংকটে পড়ে। ফলে সড়কে গণপরিবহন সংকট দেখা দেয়। খাবারের দাম বেশি আদায়ের পাশাপাশি বাড়তি গাড়িভাড়াও বেশি গুনতে নগরবাসীকে। শুক্রবার বিকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলেও চাপ একেবারে কম ছিল। তবে শনিবার থেকে চাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বর্তমানে বাসাবাড়ির গ্যাস সরবরাহ অনেকটা স্বাভাবিক।
অন্যদিকে সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাসের চাপ কম থাকায় শনিবারও নগরে গণপরিবহনের সংকট ছিল। সিএনজি, বাস, মিনিবাস, টেম্পু, লেগুনা, অটোরিকশার সংখ্যা কম ছিল। তবে কিছু কিছু গাড়ি বিকল্প হিসেবে অকটেন দিয়ে চালালেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ডিলার্স অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটরস অ্যাসোসিয়েশনের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি আহসানুর রহমান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'গ্যাস সরবরাহ শুরু হলেও চাপ কম। আগে ১০ মিনিটে গাড়িতে যে পরিমাণ গ্যাস দেওয়া হতো, এখন তা দিতে ২০ মিনিট সময় লাগে। গ্যাস সংকটের মধ্যে শুক্রবার রেকর্ড পরিমাণ অকটেন বিক্রি হয়েছে।'