শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ফেরি ও যাত্রীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন যন্ত্র চালক হুমায়ুন
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/01/25/humayun.jpg)
ফেরিটি (রজনীগন্ধা) যখন ডুবতে শুরু করে তখন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ফেরিটির ২য় শ্রেণীর যন্ত্র চালক মো. হুমায়ুন কবীর ফেরিটিকে রক্ষায় এবং ফেরিতে থাকা মানুষদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।
এর আগে গত ১৭ই জানুয়ারি সকালে ৯টি ট্রাক নিয়ে পদ্মায় ইউটিলিটি ফেরি রজনীগন্ধা ডুবে যাওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন হুমায়ুন।
সর্বশেষ গত সোমবার (২২ জানুয়ারি) বিকালে ফেরিটি যেখানে ডুবেছিল সেখান থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে নদী থেকে হুমায়ূনের লাশটি উদ্ধার করা হয়।
গত ১৭ই জানুয়ারি সকালে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় পদ্মা নদীতে ফেরি ডুবির ঘটনায় নিহত ফেরিটির (রজনীগন্ধা) ২য় শ্রেণীর যন্ত্র চালক মো. হুমায়ুন কবীরের সহকর্মীদের বরাত দিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর কাছে তার শেষ মুহূর্তের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন বিআইডাব্লিউটিসি'র পাটুরিয়া ফেরি সার্ভিস ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রুবেলুজ্জামান।
তিনি বলেন, "ফেরিতে যখন পানি ওঠা শুরু করে তখন হুমায়ুন চেষ্টা করছিলেন তার জায়গা থেকে ফেরিটি রক্ষায় সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়ে যেতে। শেষে যখন ফেরিটি ডুবতে শুরু করে, হুমায়ুন ফেরিতে থাকা শেষ ব্যক্তিটিকেও পানিতে নামিয়ে দিয়েছিলেন যাতে করে সে বেঁচে যেতে পারে। সবাইকে নামানোর পর তিনি নিজে নামার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এর পরে আসলে ঠিক কি হয়েছিলো সেটি আর জানা যায়নি। ফেরিটিতে যারা ছিল তাদের ধারণা, কোন একটি ট্রাকের পাশে চাপা পড়ে সে আটকা পড়েছিলো"।
বিআইডাব্লিউটিসি'র কর্মকর্তা ও হুমায়ুন কবীরের সহকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া থানার মাটিভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা হুমায়ুন ৩ সন্তানের জনক ছিলেন।
২০১১ সালে গ্রিজার পদে বিআইডাব্লিউটিসিতে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ডুবে যাওয়া ফেরি রজনীগন্ধায় ২য় শ্রেণীর যন্ত্রচালক হিসেবে তার কাজের বয়স এক বছরও পূর্ণ হয়নি। বিআইডাব্লিউটিসি'র নিয়মানুযায়ী কোন স্টাফ একটি ফেরিতে সর্বোচ্চ ২ বছর কাজ করতে পারেন। এরপর তাকে আবারও অন্যত্র বদলি করা হয়।
ফেরিটিতে দায়িত্ব পালন ছাড়াও হুমায়ুন ছিলেন বিআইডাব্লিউটিসি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের (আরিচা অঞ্চল) সভাপতি। গত বছর নারায়ণগঞ্জ থেকে পাটুরিয়ায় রজনীগন্ধা ফেরিতে যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। সহকর্মীদের কাছে একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে বেশ প্রশংসিত ছিলেন তিনি।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ে রুটের চলাচলকারী খানজাহান আলী ফেরির ২য় শ্রেণীর যন্ত্রচালক ও বিআইডাব্লিউটিসি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের (আরিচা অঞ্চল) সহ-সভাপতি নাজমুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, হুমায়ুন যে শুধু একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন তা নয়, তিনি অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ ছিলেন। কারো কোনো বিপদ আপদ হলে সবার আগে তিনি এগিয়ে যেতেন।
নাজমুল আরো বলেন, "তিনি যখন বুঝতে পারেন ফেরিতে পানি উঠছে, তিনি চিৎকার চেচামেচি করে সবাইকে ঘুম থেকে ওঠান। এরপর ফেরি ডুবতে শুরু করলে সবাইকে ফেরি থেকে নামতে সাহায্য করলেও তিনি নিজেকে বাঁচাতে পারেননি ।"
বিআইডাব্লিউটিসির পাটুরিয়া ফেরি সার্ভিস ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রুবেলুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণীর যন্ত্র চালকের কাজ হচ্ছে ফেরির ইঞ্জিন ও মেশিনগুলো দেখভাল করা। ঘটনার দিন হুমায়ুন ইঞ্জিন রুমে পাম্পের কাজ তদারকি করছিলেন।
বিআইডাব্লিউটিসির কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনা কবলিত ফেরিটিতে সেদিন ফেরি মাস্টার (ইনচার্জ) ছিলেন মেহের আলী নামে একজন। যদিও অনেক চেষ্টা করেও মেহের আলীর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
তারা জানান, মেহের আলী বরাবরই তাদের কাছে দাবি করে আসছেন ঘটনার দিন সকালে ফেরিটি নোঙর করা অবস্থায় একটি বাল্কহেড ফেরিটিকে ধাক্কা দেয়। তবে মূল ঘটনা অর্থাৎ ফেরির তলার কোন অংশ ফেটেছে কিনা সেটি ফেরিটির না তোলা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
বর্তমানে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে চলাচলকারী ছোট-বড় মোট ১৬টি ফেরির মধ্যে রজনীগন্ধা ছিল একটি। এটি তৈরি করা হয় ২০১৪ সালে। ফেরিটি সাধারণত ৯টি ট্রাক বহনের সক্ষমতা রাখে এবং এর ওজন বহনের সক্ষমতা ২৫০ টন। ফেরিটির ডকিং শিডিউল ছিল (চেকআপ শিডিউল) আগামী এপ্রিলে। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের নভেম্বরে ফেরিটির ডকিং (চেকিং) সম্পন্ন হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনও ফেরি ডুবে যাওয়ার কারণ তদন্ত করছে এই দুর্ঘটনার কারণ জানার জন্য। ২৩ জানুয়ারি ডুবে যাওয়া ফেরিটি উদ্ধার করার পর বালি পরিষ্কার করার জন্য নদীর তিন ফুট উপরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।