দায়িত্বে অবহেলাই পাটুরিয়ায় রজনীগন্ধা ফেরি ডুবির কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা
দায়িত্বে অবহেলার কারণেই গত ১৭ই জানুয়ারি সকালে ৯টি ছোট-বড় ট্রাক নিয়ে ঘন কুয়াশার মধ্যে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় পদ্মা নদীতে ইউটিলিটি ফেরি রজনীগন্ধা ডুবির ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এর আগে গত বুধবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে বিআইডাব্লিউটিএ'র উদ্ধারকারী জাহাজ 'প্রত্যয়' এর মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে ডুবে যাওয়া ফেরিটিকে উদ্ধার করে তীরের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। এরপর ফেরিটি পরিদর্শন শেষে বিআইডাব্লিউটিসি'র পাটুরিয়া ফেরি সার্ভিস ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো রুবালুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছিলেন, উদ্ধারের পর ফেরিটির তলার অংশ সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, ফেরিটি উদ্ধারের পর আমরা এর তলা এবং পাশের অংশ সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পেয়েছি। এছাড়াও ফেরিতে মেজর কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও বলেন, তদন্ত কমিটি বিষয়টি নিজে কাজ করছে। তদন্ত শেষেই আসলে জানা যাবে আসলে কী কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল।
এছাড়াও ওভারলোডিংয়ের কারণে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ফেরিতে তো লোডলাইন রয়েছে। কাজেই যদি লোডিংয়ের সময় ওভারলোডিং ইস্যু থাকতো তাহলে শুরুতেই হয়তো পানি পাশ থেকে উঠতো। আর এমনটা হলে নিশ্চয় ফেরি মাস্টার লোড ঠিক করে নিতেন।
তবে বিআইডাব্লিউটিসির একটি সুত্র জানায়, যেহেতু ফেরিটির তলা ও পাশের অংশে উল্লেখযোগ্য কোনো ফাটল কিংবা কোনো আঘাতের চিহ্ন কর্মকর্তারা দেখতে পাননি, তাই প্রাথমিকভাবে ঘটনার দিন ফেরি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে বিষয়টি তদন্তনাধীন থাকায় বিষয়টি নিয়ে অফিসিয়ালি বিআইডাব্লিউটিসির কোন কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি।
যদিও ফেরি ডুবির ঘটনার পর ফেরিটির সেকেন্ড মাস্টার মো. আঞ্জুমান ইসলামকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।
এর আগে গত ১৭ই জানুয়ারি সকালে ঘন কুয়াশার মধ্যে ঘাটের কাছাকাছি নোঙ্গর করে থাকা অবস্থায় ৭টি বড় ট্রাক ও ২ টি ছোট ট্রাক নিয়ে পদ্মা নদীতে ডুবে যায় ইউটিলিটি ফেরি রজনীগন্ধা।
এ ঘটনায় নিহত হন ফেরিটির ২য় শ্রেণির যন্ত্রচালক মো. হুমায়ুন কবীর। সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারি বিকালে ফেরিটি ডোবার স্থান থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে হুমায়ুন কবীরের লাশ নদীতে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে উদ্ধারকর্মীরা।
বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এসময় বিভিন্ন মহল থেকে ফেরিটি নদীতে চলার উপযুক্ত ছিল কি-না এমন প্রশ্ন ওঠে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউটিলিটি ক্যাটাগরির ফেরিটি ২০১৪ সালে তৈরি, যার ৯টি ট্রাক বহনের ক্ষমতা রয়েছে, ওজনে যা ২৫০ টন। সেই সাথে এটিও স্পষ্ট হয় যে, ফেরিটি তার লাইফলাইন অতিক্রম করেনি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কীভাবে ফেরিটি নোঙ্গর করা অবস্থায় ডুবে গেলো সেটি নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরি হয়।
দুর্ঘটনার পর বিআইডাব্লিউটিসি'র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুর্ঘটনার সময় ফেরিটিতে ইনচার্জ মাস্টারের দায়িত্বে ছিলেন মেহের আলী। যদিও দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করেও তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
বিআইডাব্লিউটিসি'র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দূর্ঘটনার পর থেকে ফেরিটির ইনচার্জ মাস্টার মেহের আলী তাদের জানিয়ছেন দূর্ঘটনার সকালে একটি বাল্কহেড নোঙ্গর করা অবস্থায় ফেরিটিকে ধাক্কা দিলে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়। মাত্র এক দেড় ঘন্টার মধ্যেই কাত হয়ে পানিতে তলিয়ে যায় ফেরিটি।
রজনীগন্ধা ফেরিটি ডুবে যাওয়ার পর বিআইডাব্লিউটিসি'র সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে কীভাবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে ফেরি চলাচল পরিচালনা করা হয় এবং কীভাবে ফেরির নিয়মিত চেকিং ও যাবতীয় বিষয়াদি ব্যবস্থাপনা করা হয় সেটি বোঝার চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
বিআইডাব্লিউটিসি'র কর্মকর্তারা জানান, মেরিন 'ল' অনুযায়ী প্রতিটি ফেরির জীবনকাল ধরা হয় ৪০ বছর। এর পরেও যদি কোন ফেরি চলাচল করে সেক্ষেত্রে ফেরিটিকে সম্পূর্ণভাবে পুনর্বাসন করা হয়। যেমন এর তলার প্লেট থেকে শুরু করে ইঞ্জিন ও যাবতীয় মেশিনারিজ বডি সবই চেইঞ্জ করা হয়। শুধু থেকে যায় এর নাম।
বর্তমানে এমন ৪টি ফেরি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে চলাচল করছে। ফেরি ৪টি হলো, ঢাকা, কুমিল্লা, করবী ও ফরিদপুর।
সাধারণত নদীতে ফেরি চলাচলের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজন না হলে প্রতি ৫ বছরে ২ বার প্রতিটি ফেরিকে রুটিন চেকআপের জন্য ডকিং ইয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে ফেরিটির চেকিং সম্পন্ন হয়, যেমন এর তলার অবস্থাসহ যাবতীয় বিষয়।
মেরিন 'ল' অনুসারে কোন ফেরির তলা ৩০ শতাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হলে সেটি শতভাগ পরিবর্তন করা হয়। দূর্ঘটনার শিকার ফেরি রজনীগন্ধার সর্বশেষ এমন রুটিন চেকিং সম্পন্ন হয়েছিলো ২০২০ সালের নভেম্বরে। আগামী এপ্রিলে ছিলো এর পরবর্তী ডকিং সিডিউল।
বিআইডাব্লিউটিসি'র কর্মকর্তারা জানান, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে চলাচলকারী মোট ১৬ টি ফেরির মধ্যে কোনটিরই তলা সর্বশেষ চেকিং রিপোর্ট অনুসারে ১০ থেকে ১২ শতাংশের বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত ছিলো না। সর্বশেষ চেকিংয়ে রজনীগন্ধা ফেরিটির তলার প্লেটও কোথাও ৫, কোথাও ১০ ও কোথাওবা ১২ শতাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত ছিলো।
রজনীগন্ধা ফেরিটির তলার প্লেটের পুরুত্ব ছিলো অন্তত ৮ মিলিমিটার। তবে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া যেহেতু কোন ফেরি ২ থেকে ৩ বছরের আগে ডক ইয়ার্ডে চেকআপের জন্য পাঠানো হয়না। কাজেই এই মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে পানিতে থাকায় কোন ফেরির তলা চেকিং এর সুযোগ থাকে না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
সাধারণত ফেরির স্টাফরা নিয়মিত চেকিংয়ের সময় এর কোন ট্যাংকে পানির পরিমাণের হেরফের হলে এর কারন অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেন। তখন যদি মনে হয় এটির তলার প্লেটে কোন সমস্যা রয়েছে তবে সেটি ডকিং ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া ফেরির পাশের কোন অংশে বা উপরের কোন অংশ বা পার্টস যদি নষ্ট বা আঘাতপ্রাপ্ত হয় তবে সেটি নিয়মিত মেইন্টেন্যান্সের সময় মেরামত করা হয়।
তবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে চলাচলকারী একাধিক ফেরি স্টাফ ও বিআইডাব্লিউটিসি'র কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এখনো ফেরির লোডিং ইস্যু চেক করা হয় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে।
সাধারণত ফেরির গায়ে থাকা লোডিং লাইন দেখে এটি ধারণা করা হয় এতে ওভারলোড হয়েছে কি-না। বিশেষ করে ঘাটে কোন যানবাহন আসার পর ফেরিতে ওঠার সময় এগুলোর কোনটি ওভারলোডেড কি-না সেটি যাচাইয়ের সুযোগ কম থাকে ফেরি স্টাফদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডাব্লিউটিসি'র এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, "আমাদের দেশে ওভার লোড নিয়ে যানবাহন চলাচলের একটা অভ্যাস রয়ে গেছে। কাজেই দেখা যায় ৯টি ট্রাকে যা ওজন হওয়ার কথা তার থেকে বেশি হয়ে যায়। এমনটা হলেও আসলে সেভাবেই ফেরি চলাচল করে। সাধারণত ফেরির সক্ষমতা অনুসারে যে'কটি যানবাহন বহন করার হিসাব করা হয়, সেই কটি যান নিয়েই ফেরি চলাচল করে। কিন্তু দেখা যায় এতে অনেক সময় বেশি লোড হয়ে যায়।"
আবার এমন যদি হয় বেশি হলে যানবাহন কমিয়ে ফেরি চলবে, তখন দেখা যাবে সংখ্যায় অর্ধেক যান নিয়ে ফেরি চলতে হচ্ছে। এমন হলে তো দীর্ঘ যানজট তৈরি হবে, তখন আবার আরেক ইস্যু তৈরি হবে।
যদিও ওভার লোড নিয়ে ফেরি চলাচল করে না বলে জানিয়েছেন বিআইডাব্লিউটিসি'র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (কমার্স) মো. খালেদ নেওয়াজ।
টিবিএস'কে এই কর্মকর্তা বলেন, "প্রতিটি গাড়িই তো স্কেলে লোড মাপিয়ে আসে। কাজেই ওভারলোড হওয়ার সুযোগ থাকে না। তাছাড়াও ফেরির লোড লাইন রয়েছে।"
তবে ঘাট থেকে ফেরিতে ওঠার সময় কীভাবে কতগুলো যান কতটুকু ভার নিয়ে ফেরিতে উঠছে সেটি বিআইডাব্লিটিসি কীভাবে ব্যবস্থাপনা করে এবিষয়ে জানতে চাইলে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডাব্লিউটিসি'র এক কর্মকর্তা টিবিএস'কে জানিয়েছেন, ওভার লোডিং ইস্যু সমাধানে বিআইডাব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহন করেছে। যার মধ্যে রয়েছে ঘাট থেকেই কোন গাড়িতে কতটুকু ওজন রয়েছে সেই সংক্রান্ত একটি স্টিকার গাড়ির সামনে লাগিয়ে দেওয়া এবং ডিজিটাল স্কেলের ব্যবহার ইত্যাদি। যাতে করে লোডিং ইস্যুতে ফেরির স্টাফরা খুব সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং খুব শীঘ্রই এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের দিকে যাবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
এছাড়াও নতুন করে নির্মিত ফেরিগুলোতে নিরাপত্তা ইস্যু বিবেচনায় এসবের তলায় ডাবল লেয়ারের প্লেট দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। অর্থাৎ কোন ফেরির তলার একটি প্লেট কোন কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যেন ফেরিটির অপর প্লেটটি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে সেটি নিশ্চিত করা হচ্ছে।