আতঙ্ক নিয়ে বাড়ি ফিরছেন সীমান্তবাসী, চাষিরা এখনো উৎকণ্ঠায়
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে অনিরাপদ হয়ে ওঠা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষজন বাড়ি ফিরছেন। টানা ৫ দিনের সংঘাতে সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন ও কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কিছু এলাকায় গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ে। এতে দুই জনের প্রাণহানি ও অন্তত ১০ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরপর থেকে সীমান্ত এলাকার মানুষদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল নিরাপদে। তবে বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে বাড়ি ছাড়া মানুষ ফিরতে শুরু করেছেন। তবে তাদের চোখেমুখে এখনো আতঙ্কের ছাপ।
গত শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) মিয়ানমার থেকে আসা গোলাগুলিতে ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু বাজার এলাকার কোনারপাড়া ও হিন্দুপাড়ায় বাড়িঘর প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল। এরপর থেকে এই এলাকার মানুষ প্রায় ঘর ছাড়া। বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে সীমান্ত-লাগোয়া এলাকার মানুষ অল্প অল্প করে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। বাজারের কিছু কিছু দোকানপাটও খুলেছে। তবে চাপা আতঙ্কও বিরাজ করছে স্থানীয়দের মধ্যে।
গত শনিবার কোনারপাড়ার মো. ইউনুছের বাড়ির ছাদ ভেঙে মর্টার শেল পড়ে। এই বাড়িটির কয়েকশ মিটার দূরেই মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকি ছিল। যা বর্তমানে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির দখলে রয়েছে। ইউনুছ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ওই ঘটনার পড়ে আমরা এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আজ আমি আর আমার মা এসেছি। আমাদের পরিবারের ১৯ জন উখিয়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। ফিরে এসে এখন বাড়িঘর পরিষ্কার করছি। আস্তে-ধীরে বাকিরা বাড়িতে আসবে।"
"তবে সীমান্ত দিয়ে এখনো আরাকান আর্মিকে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। তাই আমরা আতঙ্কে আছি"- বলেন তিনি।
পার্শ্ববর্তী নোয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "সোমবার রাতে তুমুল গোলাগুলির শব্দে আমরা বাড়ি ছেড়েছিলাম। বুধবার পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ায় আবার ফিরেছি। তবে পরিবারের শিশুদের এখনো আনিনি।"
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "কিছু এলাকার মানুষ বুধবার রাতেই চলে এসেছেন। আতঙ্কে বাড়ি ছাড়লেও ঘর-বাড়ির মায়ায় তাঁরা চলে এসেছেন। বৃহস্পতিবারও পরিস্থিতি শান্ত।"
শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন বিজিপি শিবির দখলকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী দলগুলোর সংঘর্ষ চলছে। ক্রমাগত গুলি, মর্টার শেল ও রকেট বিস্ফোরিত হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় এক বাংলাদেশিসহ দুজন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের সীমান্তে দুজন নিহত হওয়ার পর স্থানীয়দের মধ্যে ক্রমশ আতঙ্ক বাড়তে থাকে। সোমবার ও মঙ্গলবার গোলাগুলি বেশি থাকলেও বুধবার ও বৃহস্পতিবার সীমান্তের পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত। এ পর্যন্ত ঘুমধুম ইউনিয়নের ১৮০ পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছেন।
সংঘর্ষের জেরে সীমান্ত-লাগায়ো বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এপর্যন্ত ৩৩০ জন বিজিপি, কাস্টমস, সেনা কর্মকর্তাসহ মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে ঢেঁকিবনিয়ার পাশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়।
তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকিটি বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলার লোকালয়ের একদম কাছাকাছি। ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি থেকে বাংলাদেশের লোকালয় প্রায় ৮০০ মিটার দূরে। ঢেঁকিবনিয়া ও ঘুমধুমের মাঝখানে নাফ নদীর সরু একটি শাখা ও প্যারাবন রয়েছে। এ কারণে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে গোলাগুলির সময় বাংলাদেশের বসতঘরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে।
জীবিকার তাগিতে আতঙ্ক নিয়েই কাজে ফিরছেন তাঁরা:
তমব্রু বাজারের নাস্তার দোকানী নবী হোসাইন দুদিন পর তার দোকান খুঁলেছেন। বৃহস্পতিবার চুলায় নাস্তা ছাড়তে ছাড়তে তিনি টিবিএস প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন। "দোকান না খুললে খাবার জুটবে না। তাই দোকান খুলেছি। অল্পস্বল্প নাস্তা বানিয়েছি। মানুষ এখনো তেমন আসেনি। বাড়িঘরের পুরুষ সদস্যরা আসছেন। নারী-শিশুরা আরো পরে ফিরবেন।"
গত সোমবার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল পড়ে দুজন নিহত হয়েছিলেন। নিহত হোসনে আরার দেবর আবদুর রশিদও বৃহস্পতিবার কাজে ফিরেছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, "খেতে মরিচ, টমেটো, বেগুন চাষ করেছিলাম। এগুলো পরিচর্যা করতে পারিনি গত তিন দিন। আজ কাজে নেমেছি। ভয় কাটেনি। তবুও কাজে ফিরতে হয়েছে। কারণ আমাদের সব বিনিয়োগ জমিতে।"
একই এলাকার আরেক কৃষক আবু সিদ্দিক টিবিএসকে বলেন, কুতুপালংয়ে শ্বশুরবাড়িতে দুদিন কাটানোর পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ফিরেছি। আমি জমিতে কাজ করেই জীবন চালাই। ভয় পেলেও কিছু করার নেই।"
ঘুমধুম ইউনিয়নের নয়াপাড়া বাজারের সবজি দোকানি মফিজুল হক টিবিএসকে বলেন, "দোকানে কিছু সবজি তুলছেন। এখন পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক। তবে ভয় লাগছে।"
সীমান্ত-লাগোয়া জমিতে ফিরতে পারছেন না চাষিরা:
দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক এম. সাজেদুল্লাহর পৈত্রিক জমি রয়েছে সীমান্ত-লাগায়ো জলপাইতলী গ্রামে। মাত্র ৭০০ মিটার দূরেই মিয়ানমারের সীমান্ত। সীমান্ত-লাগায়ো চিংড়ি প্রকল্পে যেতে পারছেন না চাষিরা।
এম. সাজেদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "মিয়ানমারের সরকার বাহিনী এক প্রকার পরাজিত। আমাদের পার্শ্ববর্তী-সীমান্ত এখন বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির দখলে। তাদের কোন আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ নেই। তাই তারা গুলি ছুড়তে পারে— এমন আতঙ্ক আছে। এই ভয়ে সীমান্ত এলাকার মানুষেরা তাদের চাষাবাদের জমিতে যেতে পারছেন না।"
তিনি বলেন, "আজ সকালে একজন সীমান্তের কাছাকাছি জমিতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তখন ফাঁকা গুলির শব্দে তিনি ফিরে এসেছেন।"
তমব্রু বাজারের কোনাপাড়ার কৃষক আবু কালাম টিবিএসকে বলেন, "সীমান্তে আরাকান আর্মির যে হাঁটছে, তা দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কীভাবে সীমান্ত-লাগায়ো আমাদের চাষের জমিতে যাব! ভয়ে কাছেই যেতে পারছি না।"
একই এলাকার ৭৩ বছর বয়সী আবু সিদ্দিক একেবারে সীমান্তঘেঁষা প্রায় ৫ একর জমিতে, মরিচ, বাদাম, ভূট্টা, আলু, সীম, ফেলু দানা চাষ করেছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, "১ লাখ ৭২ হাজার টাকা শ্রমিক খরচ দিয়েছি কিছুদিন আগে। শুনেছি, আমার জমিতে মানুষের মরদেহ আছে। ভয়ে জমিতে যেতে পারছি না। ফসল নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।"
@জলপাইতলী গ্রামে এখনো আতঙ্কের ছায়া:
বৃহস্পতিবার দুপুরে নিহত হোসনে আরার জলপাইতলী গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলছেন। গত সোমবার দুজন নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকে এই এলাকার মানুষজন আতঙ্কের ঘর-বাড়ি ছাড়েন।
মর্টার শেল পড়া হোসনে আরার বাড়ির কয়েকগজ দূরে মুদির দোকান রয়েছে মাহমুদুল হকের। বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, তিনি দোকানের সামনের অংশটি ঝাড়ু দিচ্ছেন। টিবিএসকে মাহমুদুল বলেন, "গোলাগুলি থামায় বুধবার রাতে বাড়ি ফিরেছি। এখন দোকান খুলেছি। কিন্তু, আতঙ্কেও আছি।"
হোসনে আরার বাড়ির সামনের মসজিদে বৃহস্পতিবার জোহরের নামাজের পর কথা এলাকার অন্তত ছয় জন বাসিন্দার সঙ্গে। এই মসজিদের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে হোসনে আরাকে। নামাজ শেষে হোসনে আরার স্বামী বাদশা মিয়া, বড় ছেলে শফিউল আলম, ছোট ছেলে মো. ইব্রাহিম কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সঙ্গে থাকা এক প্রতিবেশী বলেন, "আমরা কখনো কল্পনাও করিনি এমনটি ঘটবে। কারণ হোসনে আরার বাড়ির পাশে পাহাড় ছিল। এটি নিরাপদ ধরা হয়। এলাকার মানুষ শোকাহত এবং পাশাপাশি আতঙ্কিতও।"
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ টিবিএসকে বলেন, "গত দুদিন ধরে পরিস্থিতি শান্ত। আমরা এলাকাবাসীকে আনুষ্ঠানিকভাবে আসতে বলিনি। তবু সবাই নিজ উদ্যোগে জন্মস্থান, বাবা-দাদার ভিটায় আসছেন। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সতর্ক আছেন। আমরা সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছি।"
থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের গণমাধ্যম দ্য ইরাবতীর প্রতিবেদন অনুসারে, গত চার দিনে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ ঘাঁটি আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং সশস্ত্র সংগঠনগুলো মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল ও রাজ্য, সাগাইং, মগওয়ে এবং মান্দালয় অঞ্চলের পাশাপাশি কাচিন ও কারেন রাজ্যে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে তাদের হামলা জোরদার করার কারণে এই হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
(উখিয়া-ঘুমধুম-টেকনাম সীমান্ত থেকে জানিয়েছেন টিবিএসের প্রতিবেদক জোবায়ের চৌধুরী)