দই বিক্রির টাকায় গড়েছেন ১৪ হাজার বইয়ের পাঠাগার, তার একুশে পদক জয়ে বাড়িতে ভিড় গ্রামবাসীর!
এবার একুশে পাচ্ছেন 'সাদা মনের মানুষ' খ্যাত দই ব্যবসায়ী জিয়াউল হক। সমাজসেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ২১ জন বিশিষ্ট নাগরিককে একুশে পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এদের মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউল হকের নাম।
পদকের জন্য মনোনীত হওয়ার পর অভিব্যক্তি জানাতে গিয়ে এই গুণীজন জানান, 'ওই খবর দেখেই আমার হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে।'
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার বাসিন্দা জিয়াউল হক। দই ব্যবসা থেকে শিক্ষানুরাগী হওয়া সাদা মনের মানুষ প্রায় ৫০ বছর ধরে মানবসেবায় নিজেকে মেলে ধরেছেন।
গত মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় জিয়াউল হক একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন।
চলতি মাসের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরস্কারপ্রাপ্তদের পদক দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রত্যেককে ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, এককালীন চার লাখ টাকা ও একটি সম্মাননাপত্র দেওয়া হবে।
ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে জিয়াউল হককে 'সাদা মনের মানুষ' পদকে ভূষিত করে ইউনিলিভার বাংলাদেশ।
একুশে পদক পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপর প্রতিদিন বহু শুভাকাঙ্ক্ষী বাড়িতে আসছেন। অনেকে ফোন করে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন।
জিয়াউল হক নিজের অনুভূতি সম্পর্কে বলেন, 'ওই খবর দেখেই আমার হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। তখন মনে হয়েছে ভালো কিছু দিলে ভালো কিছু পাওয়া যায়। সেই স্বীকৃতিই মনে হয় পেলাম।'
তিনি বলেন, 'আমার বয়স এখন ৯১ এর কোঠায়। কিন্তু এই খবর শোনার পর আমার বয়স তরুণদের মতো হয়ে গেছে। মনে মনে আরও কাজের উদ্দীপনা পাচ্ছি। '
জিয়াউল হক বাড়ি ভোলাহাটের ৩ নম্বর দলদলী ইউনিয়নের চামা মুশরিভুজা গ্রামে। তার বাবার নাম মরহুম তৈয়ব আলী মোল্লা এবং মায়ের নাম শরীফুন নেছা।
ব্যক্তিগত জীবনে তার দুই স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান রয়েছে। প্রথম স্ত্রী সারাবান তহুরার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় স্ত্রী ফরিদা হককে নিয়ে বটতলা গ্রামে বসবাস করছেন।
জিয়াউল হকের মূল পেশা দই বিক্রি। আর তার নেশা দই বিক্রি করার টাকা দিয়ে বই কেনা। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক কাজ করেন দই বিক্রির অর্থ দিয়ে। এই নেশাই তাকে করেছেন কীর্তিমান।
আলোকিত গুণীজন জিয়াউল হক লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নেন তিনি।
১৯৬২ সাল থেকে বিভিন্নভাবে মানুষজনকে সহযোগিতা করতেন জিয়াউল হক। এসবে অর্থের জোগান আসতো তার দই বিক্রির টাকা থেকে। বিয়ের পর তার এমন কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহ দিতেন প্রথম স্ত্রী।
পরে ১৯৬৯ সালে নিজের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন 'জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার। পাঠাগারটিতে বর্তমানে ১৪ হাজার বই আছে।
তিনি বুঝেছিলেন শিক্ষিত হতে হলে শুধু পাঠ্যবই যথেষ্ট নয়, আবার তার এলাকার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানদের পাঠদান ধরে রাখতে পাঠ্যবইও প্রয়োজন। এ জন্য জিয়াউল হক দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিতেন। বছর শেষে আবার ফেরত নিয়ে আরেক শিক্ষার্থীদের দিতেন।
পাশাপাশি স্থানীয় হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় পাঠ্যবই, পবিত্র কোরআন মাজিদ ও এতিমদের পোশাকও দিতেন। বর্তমান সময়ে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগে অনেক ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে আসছেন। জেলা ছাড়া রাজশাহীর বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও বই দেন তিনি।
এছাড়া মাদ্রাসা, এতিমখানাসহ অসহায় নারী, বৃদ্ধদের অনেককেই নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা করছেন দই ব্যবসায়ী জিয়াউল হক।
শুধু মানসিক তৃপ্তি থেকে এসব সমাজসেবা কাজ করা জিয়াউল হকের অনেক শুভাকাঙ্খীও রয়েছেন। তারাও বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেন।
২০২২ সালে একটি বইয়ে তার উন্নয়নমূলক কাজের হিসাব উল্লেখ করা আছে।
এই বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে ২০২২ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৩ কোটি ২৭ লাখ ৪১ হাজার ৬৫০ টাকা সহযোগিতা হিসেবে দিয়েছেন জিয়াউল হক।
সমাজসেবামূলক কাজে অনুপ্রেরণার মানুষদের সম্পর্কে জিয়াউল হক বলেন, আমার প্রথম স্ত্রীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল আমার এসব কাজে। দারিদ্রতার মধ্যে তার সমর্থন ছাড়া কখনও এত কিছু করা সম্ভব ছিল না। আট বছর আগে তিনি মারা যান। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীও আমাকে প্রচুর উৎসাহ দেন।
পরিবারের বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের নাম নেন জিয়াউল হক।
তিনি জানান, এছাড়া এনবিআরের একজন কর্মকর্তা, আমার জেলার অনেক মানুষ আমাকে সহযোগিতা করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই সাদা মনের মানুষ বলেন, আমার যে সহযোগিতা করেছি তার মধ্যে দেড় কোটি টাকাই দিয়েছেন আমার শুভাকাঙ্খীরা। আর বাকি দুই কোটি টাকা আমার দই ব্যবসা থেকে এসেছে।
একুশে পদক থেকে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা কীভাবে খরচ করবেন?
এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়াউল হক বলেন, পাঠাগারটিতে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী আসা-যাওয়া করে। বিকালে তাদের বসার জায়গা হয় না। পাঠাগারটি খুব ছোট হয়ে গেছে। এই টাকা দিয়ে পাঠাগারের জন্য একটি ঘর করব।
জিয়াউল হক একুশে পদক পাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাবাসী গর্বিত ও আনন্দিত বলে জানিয়েছেন জেলা স্কাউটসের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রশিদ।
তিনি বলেন, 'তার পাঠাগারে আমরা অনেকবার গিয়েছি। সেখানে বইও দেয়া হয়েছে আমাদের। তার সাথে আমাদের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। একুশে পদকের জন্য মনোনীত হওয়ার খবর পেয়ে আমরা গতকাল বুধবার তার বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছি।'
গোলাম রশিদ আরও বলেন, 'মূলত তার মতো একজন সাদামাটা মানুষ যিনি সারাজীবন দই ব্যবসায়ের সঙ্গে নিয়োজিত থেকেছেন। নীরবে বই বিলিয়ে এসেছেন গরীব শিক্ষার্থীদের মাছে। এমন একটি কাজের সম্মাননা হিসেবে একুশে পদক দেয়া বিরল। আমরা এজন্য আরও বেশি গর্বিত যে এই ইতিহাসটা আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে লেখা হলো। তাকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে স্কাউটের পক্ষ থেকে।'
জিয়াউল হককে একুশে পদকের জন্য যারা নির্বাচিত করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দলদলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজ্জামেল হক বলেন, 'জিয়াউল হক সারাজীবন সমাজের প্রতি যে কাজ করে গেছে, তার জন্য আমরা ভোলাহাটবাসী গর্বিত। আর একুশে পদকের জন্য তাকে নির্বাচিত করায় সংশ্লিষ্টদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।'
জিয়াউল হক অতীতে তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রহনপুর স্কাউট দল, ভোলাহাট প্রেস ক্লাব, খুলনা পিপি কলেজ, শহিদ সাটু হলে জেলা প্রশাসন (১৯৯৩ সালে), চ্যানেল আই (শহিদ সাটু হলে, ২০০৫), নবাবগঞ্জ নয়াগোলা পাঠাগার, ২০০১ সালে ইটিভি (এক বছর বন্ধের পূর্তিতে) ও ২০০৮ সালে ফ্রিডম ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তাকে সংবর্ধনা দেয়।