ইউরোপে চাকরির প্রলোভন: লিবিয়ায় বন্দি ৬৩ শতাংশ বাংলাদেশি; বন্দিদের ৭৯ শতাংশ নির্যাতনের শিকার
ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিবছর বহু বাংলাদেশিকে লিবিয়া নেওয়া হয়। তবে এদের সবাইকে ভালো চাকরির স্বপ্ন দেখালেও দিনশেষে তারা ঐ কাঙ্ক্ষিত চাকুরি পায় না। উল্টো অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি হয়ে শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে।
অন্যদিকে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যাওয়া এই মানুষদেরকে ক্ষেত্রবিশেষে উল্টো জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে অর্থ। তবে এতকিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা যেন থামছেই না।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্রাকের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ৫৫৭ জন বাংলাদেশির যাত্রা, গন্তব্য, অর্থ, নিপীড়ন, উদ্ধার থেকে শুরু করে প্রত্যেকের ৫০ ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ঐ প্রতিবেদটি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এভাবে লিবিয়া যাওয়ার পথে ৬৩ শতাংশই বন্দি হয়েছেন। বন্দিদের মধ্যে ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। বন্দিদের ৭৯ শতাংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
এ ছাড়া লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ৬৮ শতাংশই মুক্তভাবে চলাচলের স্বাধীনতা হারিয়েছেন। আর ৫৪ শতাংশই বলেছেন, তারা কখনো তিনবেলা খাবার পাননি।
গত এক দশক ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়া লোকজনের মধ্যে যে-সব দেশের নাগরিকরা রয়েছেন বাংলাদেশ সেই তালিকার শীর্ষ দশে থাকছে। প্রায়ই এভাবে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত নানা দেশের ২৫ লাখ মানুষ এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গিয়েছে। এভাবে যেতে গিয়ে প্রায় ২২ হাজার মানুষ সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে অনেক বাংলাদেশি আছেন।
ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে প্রবেশে চেষ্টা করা দেশগুলোর মানুষদের মধ্যে বাংলাদেশিরা অন্যতম। এটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই পথে অন্তত ৭০ হাজার ৯০৬ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন।
এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে এভাবে যাওয়ার পথে নৌকাডুবে নয় বাংলাদেশি প্রাণ হারান। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২৬ বাংলাদেশিকে। তবে এরপরেও এমন যাত্রা থামছে না। গতকালও (শুক্রবার) লিবিয়া থেকে ১৪৪ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন।
ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজন সবচেয়ে বেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ৩১ থেকে ৩৫ বছরের লোক সবচেয়ে বেশি। এদের বেশিরভাগেরই বাড়ি মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নোয়াখালী, ব্র্যাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এলাকায়।
লিবিয়া ফেরত ৫৫৭ বাংলাদেশির তথ্য অনুযায়ী, তাদের ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালরা ভালো চাকুরির প্রলোভন দেখিয়েছিল। কিন্তু ৮৯ শতাংশই চাকুরি বা কোনো কাজ পাননি। উলটো নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছেন।
যাত্রাপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দুবাই-মিশর হয়ে লিবিয়া গেছেন সবচেয়ে বেশি মানুষ। এছাড়া ঢাকা থেকে ইস্তানবুল-দুবাই হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে কাতার হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে দুবাই-সিরিয়া হয়ে লিবিয়া গিয়েছেন অন্যরা। আর অল্প কিছু লোক ঢাকা থেকে সরাসরি লিবিয়া গিয়েছেন।
এভাবে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য অর্থ কোথায় পেয়েছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ৫৬ শতাংশ বলেছেন, তারা নিজেরাই এই টাকা জোগাড় করেছেন। ২৩ শতাংশ বলেছেন তারা পরিবারের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়েছেন।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) বলেন, "আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দালালরা এসব এলাকার অভিভাবক ও তরুণদের ভালো চাকুরি আর ইউরোপের প্রলোভন দেখাচ্ছে; যেটি বাস্তব নয়। কাজেই সাধারণ মানুষ ও বিদেশগামীদের সবার আগে সচেতন হতে হবে।"
শরিফুল হাসান আরও বলেন, "এলাকার স্থানীয় দালাল ও মানবপাচার চক্রকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে। বিশেষ করে অর্থের লেনদেন খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি যে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্র রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে লিবিয়া বা অন্য দেশে তাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে।"
শরিফুল হাসান মনে করেন, এই সমস্যা সমাধানে পাশাপাশি লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি এলাকার স্থিতিশীলতা জরুরি। নয়তো সেখানকার মানুষজন জীবন বাঁচাতে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করবে। আর সেই সুযোগে পাচারকারীরা বাংলাদেশে মতো আরো অনেক দেশের নাগরিকদের সেখানে যুক্ত করবে। কাজেই সম্মিলিতভাবে এই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।