এখনো যোগাযোগ করেনি সোমালিয়ান জলসদ্যুরা, খাবার ও পানি পাঠানোর চেষ্টা করছে মালিকপক্ষ
খাবার ও পানি নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি থাকা ২৩ নাবিকের। জাহাজটি দুবাই যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ার সময় ২৫ দিনের খাবার ও পানি মজুদ ছিল। জলদস্যুরা খাবার এবং পানি ব্যবহার করায় জাহাজে খাবারের সংকট দেখা দিতে পারে। তবে বেশি সংকট দেখা দিতে পারে পানির। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জাহাজে ২০০ মেট্রিক টন বিশুদ্ধ পানি রয়েছে। জলদস্যুরা ব্যবহার করায় জাহাজে পানির সংকট তৈরি হবে। সে ক্ষেত্রে পানির কম ব্যবহার কিংবা রেশনিং করে ব্যবহার করে এই সংকট কাটানো যেতে পারে।"
তিনি বলেন, খাবারের সংকট হলে দুম্বা ও অন্যান্য খাবার সরবরাহ করতে পারে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। কিন্তু বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের সুযোগ খুব একটি নেই।
জাহাজের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, শুক্রবার পর্যন্ত কোন কোন নাবিক তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলতে পেরেছেন। তবে শনিবার জিম্মি নাবিকরা তাদের পরিবারের সাথে কথা বলতে পারেননি। জলদস্যুরা মুক্তিপণ চেয়ে এখনো কোন ধরনের যোগাযোগ শুরু করেনি।
জাহাজ মালিকপক্ষ জানিয়েছেন, জাহাজের খাবার এবং পানির সংকটের বিষয়টি তাদের বিবেচনায় রয়েছে। জলদস্যুদের সাথে যোগাযোগ শুরু হলে বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করা হবে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দ্রুত জাহাজে খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি সরবারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, জাহাজে সাধারণত হিমায়িত মাছ, মাংস, সবজি এবং ফল, চাল, ডাল ও বিস্কুট রাখা হয়। জলদস্যুরা জাহাজে থাকায় খাবার ও পানির চাহিদা বেড়েছে। দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে খাবারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
জলসদ্যুদের কবলে পড়ে খাবার সংকটের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ২০১০ সালে এমভি জাহান মনির জিম্মি নাবিক মোহাম্মদ ইদ্রিস টিবিএসকে বলেন, "খাবার সংকট হলে জলদস্যুরা নিজেরাই খাবার নিয়ে আসে। খাবার সংকট তৈরি হলে প্রতি সপ্তাহে আমাদের জন্য দুটি করে দুম্বা নিয়ে আসতো। তবে নিত্য প্রয়োজনীয় পানির ব্যবহার নিয়ে সংকট বেশি হতো।"
উদ্বেগ বাড়ছে স্বজনদের
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি দশায় আছে ২৩ জন নাবিক। তাদের প্রত্যেকের পরিবারের সদস্যরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন। গত মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর থেকে মুষড়ে পড়েছেন স্বজনরা। জীবিত ফেরত আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন তারা।
জলদস্যুদের কবলে পড়ার একদিন পর্যন্ত স্বজনদের সাথে কথা হলেও বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার থেকে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন নাবিকদের সাথে। জাহাজ মালিক পক্ষ, এবং বিভিন্ন মাধ্যমে স্বজনদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আতঙ্কিত স্বজনরা।
এমভি আব্দুল্লাহর ইঞ্জিন অয়েলার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন (শিমুল) এর স্ত্রী রিনা আক্তার বলেন, "তিন মেয়েকে ঘিরেই তার (শামসুদ্দিন) সবকিছু। প্রতিদিনই ওদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতেন। সবশেষ মঙ্গলবার বিকাল ৫ টা ৪০ মিনিটেও ফোন করেছিলেন তিনি। এর পর গত চার দিনে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। তাকে নিয়ে আমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছি।"
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের জিম্মি নাবিক আইনুল হক অভির মা লুৎফা আরা বেগম বলেন, "করোনাকালীন সময়ে ২০২১ সালে স্বামী সুজাউল হককে হারিয়েছি। এখন বড় ছেলে অভি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি।"
দেশে ফিরলে অভিকে বিয়ে করানোর কথা ছিল। ছেলের জন্য পাত্রী দেখছিলেন তিনি। জাহাজ দুবাই বন্দরে যাওয়ার পর সেখান থেকে স্বর্ণ কেনার কথা ছিল অভির।
তিনি আরো বলেন, "কোম্পানির কাছে প্রত্যাশা যত দ্রুত সম্ভব আমার সন্তান সহ সবাইকে যেন জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি আমার ছেলেকে আমার বুকে ফিরিয়ে দিন।"
জাহাজের সর্বশেষ অবস্থান
সোমালি জলদস্যুদের হাতে অপহৃত বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ বৃহস্পতিবারের (১৪ মার্চ) নোঙর পয়েন্ট থেকে ৪৫-৫০ নটিক্যাল মাইল উত্তরে সরে গেছে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, 'জাহাজটি আগের নোঙর পয়েন্ট থেকে প্রায় ৪৫-৫০ নটিক্যাল মাইল উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছে। এটি গোদোব জিরান উপকূল থেকে প্রায় ৪ মাইল দূরে নোঙর করেছে।' গোদোব জিরান সোমালিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নুগাল প্রদেশের একটি শহর।
শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক বিবৃতিতে ভারতীয় নৌবাহিনী জানিয়েছে, অপহৃত জাহাজটি থেকে সাহায্যের আবেদন পেয়ে গত মঙ্গলবার ভারতীয় নৌবাহিনীর দূরপাল্লার মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্র্যাফ্ট এলআরএমপি পি-৮১ মোতায়েন করা হয়। এটি জাহাজের ক্রুদের অবস্থা জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও জাহাজ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বুধবার (১৪ মার্চ) এক বিবৃতিতে ইইউ'র মেরিটাইম ফোর্স জানিয়েছে, এমভি আবদুল্লাহকে অনুসরণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি জাহাজ। অপারেশন আটলান্টার অংশ হিসেবে এমভি আবদুল্লাহকে 'অনুসরণ' করার জন্য একটি জাহাজ মোতায়েন করে ইইউ।
উল্লেখ্য, মোজাম্বিক থেকে ৫০ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাইয়ে যাওয়ার পথে গত মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে জলদস্যুদের কবলে পড়ে ২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। গত রোববার মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সোমবার জলদস্যুদের কবলে পড়ে এটি।
এ নিয়ে দ্বিতীয়বার কোনো বাংলাদেশি জাহাজ জলদস্যুদের হামলার শিকার হলো। এর আগে ২০১০ সালে একই কোম্পানির এমভি জাহান মনি জাহাজও সোমালি জলসদ্যুরা ছিনতাই করেছিল। ওইসময় জাহাজে ২৫ ক্রু এবং ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ মোট ২৬ ব্যক্তি ছিলেন। মুক্তিপণ দিয়ে ১০০ দিন পর তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।