উৎপাদন শুরু করেছে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র
চলতি মাসেই পুরোদমে উৎপাদনে গেছে দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নতুন মাইলফলক অর্জন করল বাংলাদেশ।
কক্সবাজারের ৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রটি গত ৮ মার্চ পুরোদমে চালু হয়েছে বলে জানান বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) নিরোদ চন্দ্র মন্ডল। চালু হওয়ার পর থেকে কেন্দ্রটি সুষ্ঠুভাবে চলছে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার আগে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে।'
নিরোদ চন্দ্র মন্ডল আরও বলেন, 'বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২২টি টারবাইনের মধ্যে ২০টি স্থাপনের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ চলতি মাসে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।'
প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী চীনা কোম্পানির প্রতিনিধি প্রকৌশলী মুকিত আলম খান টিবিএসকে বলেন, 'বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ। এখন বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে। গত ৭ মার্চ ধারণক্ষমতা পরীক্ষা হয়েছে। ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত আছে।'
তিনি আরও জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে।
মুকিত আলম খান বলেন, 'বর্তমানে ২০টি টারবাইন চালু আছে। প্রতিটি টারবাইনের সক্ষমতা ৩ মেগাওয়াট। টারবাইনগুলো মোট ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। বাকি দুটি টারবাইন স্থাপনের কাজ চলছে।'
দিন ও রাতের উৎপাদনের পার্থক্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনের তুলনায় রাতে কিছুটা বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।
বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য সরকারের সঙ্গে ১৮ বছরের চুক্তি রয়েছে প্রকল্পের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটির।
২০২২ সালের মার্চে ১১৬.৫১ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটির নেতৃত্বে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউএস-ডিকে গ্রিন এনার্জি বিডি লিমিটেড, আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে চীনা কোম্পানি এসপিআইসি উলিং পাওয়ার কর্পোরেশন।
সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রকল্পটি। গত বছরের ২৬ মে জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলকভাবে ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
কক্সবাজার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প উদ্বোধনের মাধ্যমে বৈশ্বিক বায়ুশক্তি ক্লাবে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, এ প্রকল্প পুরোদমে চালু হওয়ার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশকে প্রতি বছর প্রায় ১৪৫ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। কয়লার ব্যবহার ৪৪ হাজার টন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ১ লাখ ৮ হাজার ৩০০ টন কমাবে এ প্রকল্প। সেইসঙ্গে ১ লাখ পরিবারের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাবে।
এছাড়া এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সময় ১ হাজার ৫০০-র বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২৫ জন কর্মকর্তা।
কক্সবাজার বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালক ইয়িন বোবো চীনা সংবাদসংস্থা শিনহুয়াকে বলেছেন, উলিং পাওয়ার কর্পোরেশন সবুজ শক্তির উন্নয়নে কাজ অব্যাহত রাখবে এবং বাংলাদেশকে 'লো-কার্বন' জ্বালানিতে রূপান্তরে সহায়তা করবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি প্রকল্পটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনে, বাতাসের গুণমান উন্নয়নে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর দেশের নির্ভরতা কমাতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশে বায়ুশক্তি
এটিই অবশ্য দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প নয়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২০০৫ সালে ফেনীতে মুহুরী নদীর তীরে বাঁধের কাছে একটি ০.৯ মেগাওয়াট সক্ষমতার বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে।
এর তিন বছর পর কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় নির্মাণ করা হয় ১ মেগাওয়াটের একটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। বোর্ডের তদারকি ও আগ্রহের অভাবে দুটি কেন্দ্রই এখন কার্যত বন্ধ।
২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য
বর্তমানে সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাট ও চুয়াডাঙ্গায় মোট ১০২ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরও তিনটি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া চাঁদপুরে একটি ৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প ও ফেনীতে একটি ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ঠিকাদার বাছাই পাইপলাইনে রয়েছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের মোংলায় একটি ৫৫ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য মোংলা গ্রিন পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে।
বাংলাদেশের ৫০০ মেগাওয়াট অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পে ডেনমার্কের ১.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ সরকারি অনুমোদন পেয়েছে।
সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে সৌর, জলবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎসহ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য নতুন কেন্দ্র নির্মাণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বর্তমানে মোট বিদ্যুতের ২ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে দেশের। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের জন্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে কমপক্ষে ১২ শতাংশ বিদ্যুৎ আসতে হবে।
এর আগে সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস্য থেকে মোট বিদ্যুতের অন্তত ৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, এই দুটি লক্ষ্যের কোনোটিই এখনও অর্জন করা যায়নি।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রস্তুত করা 'ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১–৪১'-এ বলা হয়েছে, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ফ্যাসিলিটি সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।
নদী তীরবর্তী ও পতিত জমির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুতের সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে প্রাক্কললন করা হয়েছে।