গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: শোক, আতঙ্ক আর দোষারোপ
ঢাকা–টাঙ্গাইল মহাসড়ক ধরে গাজীপুর মহানগরীর শেষ সীমানায় কোনাবাড়ী ফ্লাইওভার থেকে নামলেই মহাসড়কের উত্তর পাশে নীচে নেমে গেছে একটি গলি। গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকা। পাশেই একটি কারখান, তার কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে একটি কলোনি।
কলোনিতে ঢুকতেই উৎকট গন্ধ সরাসরি মাথায় আঘাত করে। মনে পড়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই উক্তি: 'ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে—এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।'
পূতিগন্ধময় ও ভাঙাচুরা পথ পেরিয়ে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়ে প্রায় ৩০০ মিটার দীর্ঘ গলিটির দুপাশে ছোট ছোট ঘরের সারি। একটি সারিতে ১৪–১৫টি করে ঘর। সবগুলো ঘরের বাসিন্দাদের জন্য একটি গোসলখানা ও দুটি পায়খানা। নেই পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা।
এখানকার বাসিন্দারা প্রায় সবাই ঘরের ভেতরে গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে রান্না করেন। কেউ কেউ সামনের গলিতে মাটির চুলায় রান্না করেন। বিদ্যুৎ বিলসহ ভাড়া মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। এসব ঘরে থাকেন বিভিন্ন কলকারখানায় বা দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করা নিম্ন আয়ের মানুষ। এরা কেউই স্থানীয় নয়।
এ কলোনিতে ১৮টি ঘরের মালিক শফিকুল। গত ১৩ মার্চ বিকেলে তার ঘরের গ্যাস সিলিন্ডার লিক হয়ে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার পর চুলার আগুনের সংস্পর্শে এসে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ১১ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় মোট ৩৪ জন অগ্নিদগ্ধ হন।
বিস্ফোরণের ছয়দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি ওই এলাকার বাসিন্দারা। স্বজন ও প্রতিবেশী হারানোর বেদনা এবং আবারও অগ্নিকাণ্ডের আতঙ্ক এখনো তাদের ঘিরে রয়েছে।
দুর্ঘটনার জন্য ঘরের মালিক এবং গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রেতা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। মালিকের দাবি, তিনি যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেই গ্যাস সিলিন্ডার চুলার সঙ্গে সংযোগের চেষ্টা করেছিলেন। আর সিলিন্ডার বিক্রেতার দাবি, সতর্কতা অবলম্বন করলে অথবা একজন অভিজ্ঞ লোক দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারটি সংযোগ করলে হয়তো এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।
শোক আর আতঙ্ক
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার দিন বিকেল ৪টার দিকে গলিতে লাকড়ির চুলায় রান্না করছিলেন শফিকুলের একটি ঘরের ভাড়াটিয়া মুক্তি বেগম (৪০)। বিকেল ৫টার দিকে শফিকুল তার ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার চুলার সঙ্গে সংযোগ দেওয়ার সময় চাবি ভেঙে গ্যাস ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়লে তিনি সিলিন্ডারটি গলিতে ছুড়ে ফেলে দেন। পরে চুলার আগুনের সংস্পর্শে এসে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়।
এতে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৩৪ জন অগ্নিদগ্ধ হন। আহত ৩২ জনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হয়। দুজনের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
শফিকুলের আরেকটি ঘরে মায়ের সঙ্গে ভাড়া থাকে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি এলাকার ১৩ বছর বয়সি মারিয়া। এ আগুনে তার পাশের ঘরের দুই বাসিন্দা প্রাণ হারিয়েছেন।
'আমাদের পাশের ঘরে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে থাকতেন মহিদুল ও তার স্ত্রী। তারা দুজনই মারা গেছেন। নার্গিস কোনাবাড়ী এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। মহিদুল দৈনিক চুক্তিভিত্তিক কাজ করতেন,' বলে মারিয়া।
তাদের তিন বছর বয়সি সন্তান নাহিদ এখন তার দাদা-দাদির কাছে রয়েছে।
প্রতিবেশীর মৃত্যু মারিয়াকে অনেক নাড়া দিয়েছে। চোখের সামনে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সে এখন খুবই আতঙ্কিত। 'সব সময় মনের মধ্যে ভয় কাজ করে। আবার কখনো এমন ঘটে কি না,' বলে সে।
হাসপাতালে মারা যাওয়াদের মরদেহ হাসপাতাল থেকেই সরাসরি গ্রামের নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের সকলের ঘরে এখন তালা লাগানো।
কলোনির আরেক বাসিন্দা শাহিদা বেগম ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, 'প্রথমে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। হঠাৎ চুলা থেকে আগুন ধরে বিভীষিকাময় অবস্থা — গলির ভেতরে মানুষের আর্তনাদ।'
'বর্তমানে আমরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। এখানকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা; আবার দুর্ঘটনা ঘটে কি না এসব দিয়ে খুব উদ্বিগ্ন রয়েছি,' বলেন এ বাসিন্দা।
সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর থানার শুকুর শেখ স্ত্রী কমলা বেগমকে নিয়ে এসেছিলেন ছেলের কাছে বেড়াতে। তাদের ছেলে আল আমিন স্থানীয় কারখানায় কাজ করেন। কমলা বেগমের পুত্রবধূ শিল্পী জানান, কমলা বেগম তাদের ঘর থেকে ননদের ঘরে যাচ্ছিলেন। পথে তিনি দুর্ঘটনায় পড়ে অগ্নিদগ্ধ হন। বর্তমানে তাকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
একই দুর্ভাগ্য শিল্পীর ভাগ্নে জামাই স্থানীয় কারখানার কর্মী লালনেরও (২১)। শিল্পী বলেন, 'সরকার দেশের অনেক উন্নয়ন করেছে। এখন আমাদের দাবি, এই সিলিন্ডার গ্যাস তুলে দিয়ে আমাদেরকে সরকারি সাপ্লাইয়ের গ্যাস সরবরাহ করা হোক।'
এ কলোনির আরেক বাসিন্দা হালিমা বেগমের দাবি তার ভগ্নিপতি কবির হোসেন গ্যাস বের হওয়ার সময় পাশের চুলার আগুন নেভানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তার কথা শোনেনি মুক্তি বেগম। আগুনে কবির ও তার দেড় বছর বয়সি মেয়ে দগ্ধ হয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর বিলুনিয়া ইউনিয়নের জবতলা এলাকার বাসিন্দা সুজন হোসেন এখানে স্ত্রী ও ৭ বছরের মেয়েকে নিয়ে থাকেন। 'ঘটনার পর থেকে আমি আতঙ্কের মধ্যে আছি। ভাবছি, আমি স্ত্রী-সন্তানকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেব,' বলেন তিনি।
দোষারোপ একে অপরকে
এ ঘটনায় ঘরের মালিক এবং গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রেতা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। শফিকুলের দাবি, তিনি যথেষ্ট সাবধানেই গ্যাস সিলিন্ডার চুলার সঙ্গে সংযোগের চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে সিলিন্ডার বিক্রেতা বলছেন, ঠিকমতো সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি।
শফিকুল বলেন, 'গ্যাস শেষ হয়ে যাবার পর আমার স্ত্রী তার ভাই মালেককে গ্যাস সিলিন্ডার আনতে বলেন। মালেক লালমাটিয়া এলাকার এরশাদ রানার দোকান থেকে একটি গ্যাস সিলিন্ডার এনে আমার ছেলের মাধ্যমে আমাদের ঘরে পাঠান।
'সিলিন্ডারটি চুলার সঙ্গে সংযোগ করতে গেলে চাবি ভেঙে গ্যাস ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য সিলিন্ডারটি ঘরের বাইরে গলিতে ফেলে দিই।'
তিনি দাবি করেন, এ সময় তিনি লোকজনকে কাছে না আসার অনুরোধ করলেও কেউ তার কথা শোনেননি।
শফিকুল ও তার পরিবারের লোকজন ঘরের ভেতর থাকায় তারা কেউ আহত হননি। তার ১৮টি ঘরের বাসিন্দাদের মধ্যে পাঁচজন আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। অন্যরা পাশের অন্যান্য ঘরের ভাড়াটিয়া।
বুধবার (১৮ মার্চ) কলোনিতে গিয়ে মুক্তি বেগমকে পাওয়া যায়নি। তিনি কারখানায় ছিলেন। তার ১৬ বছর বয়সি মেয়ে ফাতেমা বলে, 'আমার মা বিকেল ৪টা থেকে সেখানে রান্না করছিলেন। ৫টার দিকে শফিকুল তার সামনে সিলিন্ডার ছুড়ে ফেলেন।'
'চুলায় রান্না করা হচ্ছে দেখেও সেখানে সিলিন্ডার ফেলা কি ঠিক হয়েছে? রান্না করার মাঝখানে আমার মা পানি আনতে ঘরের যাওয়ার সময় আগুন জ্বলে ওঠে। এ কারণে তিনি দগ্ধ হননি।' অগ্নিকাণ্ডের সময় ফাতেমা বান্ধবীর বাড়িতে ছিল।
সিলিন্ডার বিক্রয়কারী ওমেগা গ্যাসের সাব-ডিলার এরশাদ রানা বলেন, 'শফিকুলের শ্যালক মালেক গ্যাস সিলিন্ডারটি একটি ছোট ছেলেকে দিয়ে ওই বাড়িতে পাঠান। নেওয়ার পথে সিলিন্ডারটি কয়েকবার আছাড় খেয়েছে, এতে সিলিন্ডারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে।'
তিনি দাবি করেন, সিলিন্ডার বিক্রি করলে তিনি সরাসরি নিজে গিয়ে চুলার সঙ্গে সংযোগ দিয়ে আসেন। 'সিলিন্ডার যে বিক্রি করে, এটি তার দায়িত্ব। মালেক সিলিন্ডার বিক্রি করেছে, এটি নিরাপদে চুলের সঙ্গে সংযুক্ত করার দায়িত্ব ছিল তার।
'মালেক নিজেও গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা করে। একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি দিয়ে সিলিন্ডারটি সংযুক্ত করলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। কারণ যারা এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে অতিরিক্ত চাবি অথবা রাইজার থাকে। একটি নষ্ট হলে আরেকটি লাগিয়ে সংযোগটি নিরাপদ করা যেত,' বলেন রানা।
দুর্ঘটনার পরদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম। এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।