অটিজম: বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান এখনও বহুদূর
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ২৬ বছর বয়সী তারিকুল আলম হিরক রাজধানী ঢাকার সুইড বাংলাদেশ স্কুলে বিশেষ শিক্ষা ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। সুইড ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুলে সেলাই করা, ব্লকের কাজ, কম্পিউটার অপারেটিংসহ বিভিন্ন কাজ শিখেছেন তিনি। বর্তমানে সুইড বাংলাদেশে অফিস সহকারী হিসেবেই কাজ করছেন; এ কাজ করে নিয়মিত বেতনও পান হিরক।
হিরক কাজের সুযোগ পেলেও দেশের অধিকাংশ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ কাজের বাইরে। অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্নরা স্কুলে শিক্ষার সুযোগ পেলেও দেশে তাদের কাজের সুযোগ খুবই কম।
টেকসই উন্নয়নের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী তাদেরকে কাজে যুক্ত করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সেজন্য সহায়ক পরিবেশ ও ট্রেনিং দরকার এবং কর্মীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। অটিজমের ধরণ অনুযায়ী, যথাযথ ট্রেনিং দিলে অটিস্টিকরাও কাজ করতে পারে বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
সুইড বাংলাদেশের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন মানুষেরা শুধু বেঁচে থাকবে, খাবে ঘুমাবে বা টিকে থাকবে সেটিই শেষ কথা নয়। আমরা চাই তাদের কাজের সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে তারা যেনো টিকে থাকতে পারে, তাদের জীবনের টেকসই উন্নয়ন দরকার।"
"সেজন্য ওদের উপযোগী কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। ওরা কী পারে, কী পারেনা– তা না দেখে তাদের কী সম্ভাবনা আছে, সেটি খুঁজে বের করতে হবে। সেই সম্ভাবনাকে কোনো পরিবেশে অ্যাডজাস্ট করে তাকে রিহ্যাবিলেটেড করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে," যোগ করেন তিনি।
এখন শারীরিকভাবে অক্ষম, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের কাজের সুযোগ বেড়েছে, কিন্তু আচরণগত সমস্যা হওয়ায় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের কেউ কাজে নিতে চায় না। তাই তাদের ট্রেনিং দিয়ে যে যেই কাজের উপযোগী, তাকে সেভাবে দক্ষ করে তুলতে হবে বলে মনে করেন মাহমুদুল হাসান।
তিনি আরও বলেন, "অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন মানুষের জন্য পরিবেশগত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত সাপোর্ট লাগবে এবং তাদের উপযোগী ট্রেনিং দিতে হবে।"
ডিজঅ্যাবিলিটি ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন মানুষ ৮৬,১৪২ জন। ২০২৩ সালের মার্চে দেশে অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন মানুষ ছিল ৭৮,২১২ জন। এক বছরের ব্যবধানে সরকারি হিসেবে প্রায় ৮,০০০ অটিজম আক্রান্ত মানুষ বেড়েছে।
শ্রমশক্তিতে অটিজম ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে পিএফডিএ– ভোকেশনাল ট্রেইনিং সেন্টার ট্রাস্ট। এই সেন্টার থেকে নানান ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে এ পর্যন্ত ২৫৫ অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির চাকরি সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এদিকে, সরকার অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন শিশুদের বিকাশ বা মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে শিশু বিকাশ কেন্দ্র ও স্কুল স্থাপন করেছে বলে জানান সূচনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ডা. মাজহারুল মান্নান। তিনি বলেন, ৩৪টি মেডিকেল কলেজে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। ঢাকাতে ১২১টি স্কুল প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে।
"তবে এসব শিশু বিকাশ কেন্দ্র শুধু অটিজম শিশুদের শনাক্ত ও ব্যবস্থাপনার জন্য। এসব ব্যক্তিদের কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করতে অন্যান্য দেশের মতো বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া এখনো সম্ভব হয়নি," বলেন তিনি।
আটিজম আসলে কী?
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) অনুসারে, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) হলো, মস্তিষ্কের পার্থক্যের কারণে সৃষ্ট এক ধরনের অক্ষমতা। এটি মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ততাকে বোঝায়। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা সামাজিক আচরণে ক্ষেত্রে দুর্বল ও পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাধারণত কম সক্ষম হয়ে থাকে। মানসিক সীমাবদ্ধতা ও একই কাজ বারবার করার প্রবণতা থেকে এদেরকে শনাক্ত করা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু টিবিএসকে বলেন, "অটিজম হলো একটি জেনেটিক সমস্যা। জন্মের ১৮-৩৬ মাসের মধ্যে একটা বাচ্চা যখন অন্য বাচ্চার সাথে মিশে না, অন্য বাচ্চারা যে ধরনের আচরণ করছে তেমন করে না, কথা বলে না- একই কাজ বারবার করে, কোনো কিছুর ওপর আসক্তি থাকলে সেটা নিয়ে থাকে সবসময়— এসব লক্ষণ দেখলে ডাক্তার দেখাতে হবে। দ্রুত শনাক্ত (আর্লি ডিটেকশন) করা গেলে অটিজম আক্রান্তদের কাজে লাগানো যায়।"
"আগে মনে করা হতো, অটিজম আক্রান্তদের বুদ্ধি নেই। কিন্তু সেটি ঠিক নয়। অটিজম আক্রান্তদের বুদ্ধিমত্তা ভালো থাকে, কিন্তু আচরণগত সমস্যা থাকে। সে কারণে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অটিজমে আর্লি ডিটেকশনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। যেসব কাজে বুদ্ধির দরকার হয়, সেসব বাদে অন্যান্য যেকোনো কাজ তারা করতে পারে। সেজন্য আর্লি ডিটেকশনে আরও গুরুত্ব দিতে হবে," যোগ করেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) সারাবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, 'সচেতনতা-স্বীকৃতি-মূল্যায়ন: শুধু বেঁচে থাকা থেকে সমৃদ্ধির পথে যাত্রা'।