স্বাস্থ্য আপা: জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার চিত্র বদলে দেওয়া দেশের নারী ‘রোগ গোয়েন্দা’
কিছু বিষয় বিবেচনায় সেলিনা খাতুন একজন গোয়েন্দার মতো। ময়মনসিংহ জেলায় তার নিয়ন্ত্রণাধীন ১০ গ্রামের তথ্যদাতা এই ৪০ বছর বয়সী। তবে কোনো অপরাধ চক্রের তথ্যের জন্য নিজের অনুগতদের ব্যবহার করছেন এমন নয়, বরং তিনি দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি-চিকিৎসাযোগ্য রোগ-এ আক্রান্তদের সন্ধান বের করেন।
সাভার দক্ষিণপাড়া গ্রামের এক অল্পবয়সী মায়ের রক্তচাপ পরীক্ষা করতে করতে সেলিনা খাতুন বলেন, গ্রামে কী ঘটছে তা অধিকাংশ গ্রামবাসীর আগেই আমি জানি। যে কোন সমস্যা সম্পর্কে আমি যত তাড়াতাড়ি জানি, তত তাড়াতাড়ি আমরা এটির চিকিৎসা করতে পারি।
দক্ষিণপাড়া থেকে কয়েক মাইল দূরে থাকেন সেলিনা। তিনি একজন জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্যকর্মী। তার অধীনে থাকা গ্রামগুলোতে কাজ করেন ১০ জন স্বাস্থ্য সেবিকা। পৃথক পৃথক গ্রামে বাস করা এসব স্বাস্থ্যসেবীদের তত্ত্বাবধায়ন করেন তিনি। স্বাস্থ্য সেবিকাদের অনেক জায়গায় আবার স্বাস্থ্য আপাও ডাকা হয়।
দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১টিতে এমন প্রায় ৫০ হাজার স্বাস্থ্য সেবিকা কাজ করেন। যারা গ্রামীণ এলাকা এবং বস্তির ঘরে ঘরে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন। যেসব স্থানে প্রচলিত স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মাধ্যমে সেবা দেওয়া কঠিন।
এটি বাংলাদেশ সরকার এবং বেসরকারী সংস্থাগুলো দ্বারা পরিচালিত কমিউনিটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কমিউনিটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বছরে প্রায় ৮ কোটি মানুষকে বিনামূল্য বা কম খরচে সেবা দেওয়া হয়ে থাকে।
এটি এমন এক উদ্ভাবনী মডেল যা নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করেছে এবং সারাদেশে স্বাস্থ্য উন্নয়নে অবদান রাখছে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার ৭৫ শতাংশ এবং মাতৃমৃত্যু ৭১ শতাংশ কমেছে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭০ এর দশক থেকে গ্রামীণ নারীদের গর্ভনিরোধক ব্যবহার দশগুণ বেড়েছে। ডিটিপি৩ টিকা (ডিপথেরিয়া, টিটেনাস টক্সয়েড এবং পারটুসিস) গ্রহণ করা গ্রামীণ শিশুর সংখ্যা প্রায় শূন্য থেকে এখন ৯০ শতাংশ হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড গ্লোবাল হেলথের ডিরেক্টর সারাহ হকস বলেন, 'মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সত্যিই একটি বড় সাফল্যের গল্প। শীর্ষ পর্যায়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন না করে অংশীজনদের এবং স্থানীয় নেতৃত্বকে জড়িত করার মাধ্যেমে এই উদ্যোগ দারুণভাবে কাজ করেছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশে কমিউনিটি স্বাস্থ্য সেবা প্রকল্প প্রথম চালু হয়েছিল। এসময় অর্থ সংকটে থাকা সরকার লাখ লাখ নারীকে পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবা প্রদানের চেষ্টা করেছিল।
মাতৃস্বাস্থ্যে সাফল্যের গল্প
সেই সময়ে, বাংলাদেশে প্রতি নারী গড়ে সাতটি সন্তান জন্ম দিতেন। যা বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রজনন হারের একটি। রক্ষণশীল সমাজের প্রচলিত নিয়মের কারণে মাত্র ৫ শতাংশ নারী গর্ভনিরোধক ব্যবহারের সুযোগ পেতেন। ধর্মীয় নির্দেশের অনুসরণে অনেক নারী ঘরেই নির্জনে কাটাতেন। তারা মৌলিক স্বাস্থ্যসেবাও পেতেন না।
যেসব নারী বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেতেন তারাও মানসম্মত চিকিৎসা পেতে বেগ পেতেন। ১৯৭১ সালে দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক ছিলেন।
তারপর থেকে নতুন গবেষণা, অভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক অগ্রাধিকার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশও তাদের প্রচেষ্টা প্রসারিত করে। পরিবার পরিকল্পনার প্রাথমিক লক্ষ্য ছাপিয়ে ১৯৮০ এর দশকে শিশু স্বাস্থ্য, ১৯৯০ এর দশকে মাতৃস্বাস্থ্য এবং ২০১০ এর দশকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের মোতায়েন করা হয়েছিল।
এখন তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নেওয়া স্বাস্থ্য সেবিকারা দিনে কয়েক ঘণ্টা বাড়ি বাড়ি পরিদর্শনে যান। তারা স্বাস্থ্যবিধি, পুষ্টি এবং পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি জনসংখ্যা সংক্রান্ত তথ্য গ্রহণ এবং রেফারেল তৈরি করেন।
আর স্বাস্থ্য সেবিকাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীরা অন্তত মাধ্যমিক পাশ এবং অন্তত একমাসের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা। তারা পুরো মাতৃত্বকালীন সময়ে সেবা দেন এবং প্রসবে সহায়তা করেন। এছাড়াও ডায়রিয়া এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মতো অসুস্থতায় চিকিৎসা দেন।
১৯৯০ সালে স্বাস্থ্য সেবিকা প্রকল্প চালু করা ব্র্যাকের স্বাস্থ্য পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির পরিচালক মোরশেদা চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য সেবিকারা নজরদারি ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। যদি কোন সমস্যা হয় তারা দ্রুত সাড়া দিতে পারে।
অপেক্ষাকৃত ছোট ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত ময়মনসিংহ। এই বিভাগে দারিদ্রের মাত্রা বেশি, স্বাস্থ্য সচেতনতাও কম। মানসম্মত চিকিৎসা পেতে অনেক দূরে যেতে হয়। সাভার দক্ষিণপাড়া গ্রামের রাস্তা কাঁচা। বাসিন্দারা প্রায়ই বিদ্যুৎ পান না।
এই ধরনের একটি রক্ষণশীল গ্রামীণ অঞ্চলে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি। গর্ভবতী নারীরা অনেক সময় পুরুষ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে চান না কিংবা নিতে দেওয়া হয় না। তবে স্থানীয় নেতৃত্বকে সম্পৃক্ত করে নারী স্বাস্থ্য সেবিকারা সেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অবহেলিত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন।
২০০৯ সালে ব্র্যাকের প্রচেষ্টা সম্প্রসারণ এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সরকার ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করে। ক্লিনিক্যালি-প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা এসব ক্লিনিক পরিচালনা করে। এখন অনেক এলাকাতেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে রোগীদের বেশিদূর যেতে হয় না।
জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ এখন ক্লিনিক থেকে ৩০ মিনিট হাঁটার দূরত্বে। ক্লিনিকগুলো প্রাথমিক চিকিৎসা, টিকাদান এবং প্রসবের সুবিধা দিয়ে থাকে।
সাভার দক্ষিণপাড়া গ্রাম থেকে এক মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত বারুরী ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার সাবিকুন নাহার বলেন, 'পাঁচ মাইল দূরে থাকা নিকটতম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তুলনায় আমরা কাছাকাছি থাকায় আরো বেশি লোকজন চিকিৎসা নিতে আসার সম্ভাবনা বেশি।
এই এলাকায় দুই বছর ধরে কেউ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়নি এবং স্থানীয়দের মধ্যে ৮৭ শতাংশ কোভিডের দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন।
মহামারী চলাকালীন, মাস্ক বিতরণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্য সেবিকারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০২১ সালে ১৫ লাখের বেশিবার প্রসবপূর্ব সেবা দেওয়া হয়েছে। আর প্রসবের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রসবোত্তর পরিদর্শনের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ বার। যক্ষ্মা পরীক্ষা করা হয়েছিল ২০ লাখের বেশি লোকের। যাদের মধ্যে ৯৬ শতাংশের সফল চিকিৎসা দেওয়া হয়। ১৫ লাখ লোকের ম্যালেরিয়া স্ক্রিনিং করা হয়।
ঢাকার ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহকারী অধ্যাপক ফারজানা মিশা বলেন, 'স্বাস্থ্য সেবিকাদের অন্যতম শক্তি হল ঘরে ঘরে গিয়ে যোগাযোগ করা। নতুন কেউ আসার চেয়ে সারাজীবন চেনা কোন ব্যক্তি তাদের কাছে যান। টিকা সরবরাহে এটি সহায়ক হয়ে ওঠে।
কিন্তু বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য সেবিকা প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও রয়েছে। দেশে স্বাস্থ্য বৈষম্য রয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব এবং টিকাদানের ক্ষেত্রে। শহরাঞ্চলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার গ্রামীণ এলাকার তুলনায় ২৪ শতাংশ কম। দরিদ্রতম পরিবারে শিশুমৃত্যুর হার ধনী পরিবারের তুলনায় দ্বিগুণ।
এছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থায়নে অনিশ্চয়তা আছে। এ কারণে বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা কঠিন। ২০২১ সালে যুক্তরাজ্য সরকার ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) থেকে তহবিল কমিয়ে ব্র্যাকের সাথে ১০ বছরের ৪৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের অংশীদারিত্বের ইতি টানে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তারা এখনো বাংলাদেশের একটি নেতৃস্থানীয় দাতা হিসেবে বিদ্যমান আছে এবং ব্র্যাককে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, স্বাস্থ্য সেবিকার সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে ৫০ হাজারে নেমেছে। বার্ষিক ঝরে পড়ার হার ১০-১৫ শতাংশ। স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে তাদের পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে প্রণোদনা দেওয়া হয়। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের সারাহ হকস বলেন, তাদের বেতন দেওয়া উচিত।
এত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও স্বাস্থ্যকর্মীরা কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। স্বাস্থ্য সেবিকা ফাতেমা খাতুন বলেন, 'আমি এই কাজটি করতে পেরে এবং মানুষের সেবা করতে পেরে গর্বিত। আমরা নারীরা একসাথে কাজ করলে অনেক কিছু অর্জন করতে পারি।'
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের 'গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি কলের' মাধ্যমে এই প্রতিবেদন তৈরিতে অর্থায়ন করেছে ইউরোপিয়ান জার্নালিজম সেন্টার।