বাংলাদেশ সমৃদ্ধিতে ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেলেও পিছিয়ে আছে স্বাধীনতা সূচকে
২০২৩ সালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে সমৃদ্ধির দিক থেকে ছাড়িয়ে গেলেও স্বাধীনতা সূচকে দেশগুলো থেকে অনেকটা পিছিয়ে ছিল।
আটলান্টিক কাউন্সিলের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি কেন্দ্রের 'ফ্রিডম এন্ড প্রসপারিটি ইন বাংলাদেশ' (বাংলাদেশে স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি) শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে সমৃদ্ধি সূচকে বাংলাদেশকে 'অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসচ্ছল' এবং স্বাধীনতা সূচকে 'অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরাধীন' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
২০২৩ সালের জন্য করা এ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সমৃদ্ধি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৪টি দেশের মধ্যে ৯৯তম। তালিকায় ভারতের অবস্থান ১৪৬তম এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১৫০তম। কিন্তু স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১ তম যেখানে ভারত ১০৪তম এবং পাকিস্তান ১১৩তম অবস্থানে রয়েছে।
সমৃদ্ধি সূচকের তালিকা করার জন্য স্বাস্থ্য, বৈষম্য, পরিবেশগত অবস্থা, সংখ্যালঘু অধিকার এবং শিক্ষা সহ মাথাপিছু জিডিপির মতো বিভিন্ন কারণ বিবেচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতা সূচকের তালিকা করার জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আইনি অবস্থার পরিমাপ করা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্কটির গবেষণায় দেখা গেছে, মৌলিক স্বাধীনতা জোরদার করলে সেটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে গতিশীল করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি কর্তৃত্ববাদী দলীয় ব্যবস্থার দিকে শক্তিশালী পরিবর্তন এসেছে। বিরোধী দলকে বয়কট করে সেটি পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ তার পনেরো বছরের শাসনকাল টিকিয়ে রেখেছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা নারী সরকার প্রধান হতে যাচ্ছেন। এটি স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও কর্তৃত্ববাদী দলীয় ব্যবস্থাগুলো প্রায়ই বিভিন্ন ঝুঁকির মুখোমুখি হয় যা সুশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই ঝুঁকিগুলো কমানোর জন্য রাজনীতি, সরকার ব্যবস্থা এবং অর্থনীতিতে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।"
সোমবার (১৫ এপ্রিল) ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) এবং দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন থেকে যৌথভাবে আয়োজিত 'প্রসপারিটি এন্ড গুড গভার্নেন্স' (সমৃদ্ধি এবং সুশাসন) শীর্ষক সম্মেলনে এই ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, "আটলান্টিক কাউন্সিল যে ১৬৪টি দেশকে তালিকাভুক্ত সেখানে (স্বাধীনতা সূচকে) 'অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরাধীন' হিসেবে তালিকাভুক্ত দেশগুলো 'সমৃদ্ধশালী' দেশ হিসেবে (সমৃদ্ধি সূচকে) তালিকাভুক্ত হয়নি। এটি থেকে বোঝা যায়, সমৃদ্ধশালী হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনি স্বাধীনতা বৃদ্ধি করতে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।"
তিনি আরো বলেন, "প্রতিটি দেশ দুর্নীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। সমস্যাগুলো এড়িয়ে না গিয়ে বরং সমস্যা মেনে নেওয়া ও সক্রিয়ভাবে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করাই আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।"
সম্মেলনের মূল বক্তা আটলান্টিক কাউন্সিলের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি কেন্দ্রের পরিচালক জোসেফ লেমোইন প্রতিবেদনের মূল ফলাফলগুলো তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে স্বাধীনতা সূচক এবং সমৃদ্ধি সূচকের উপর ভিত্তি করে গণতান্ত্রিক এবং শাসন সূচক ব্যবহার করে একটি জাতির অর্থনৈতিক অবস্থানের মূল্যায়ন করা হয়েছে।
জোসেফ লেমোইন বলেন, "তথ্যগুলো থেকে দেখা যায়, অধিক স্বাধীনতার দেশগুলো বেশি সমৃদ্ধি উপভোগ করে এবং কম স্বাধীনতার দেশগুলোর সমৃদ্ধি নিচের দিকে৷ একটি দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে উন্নত করে একটি শক্তিশালী আইনি পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরো বেশি স্বাগত জানাতে পারে।"
তিনি আরো বলেন, "অধিক স্বাধীন দেশগুলো কম স্বাধীন দেশের তুলনায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি পায়। সামগ্রিকভাবে স্বাধীনতা সূচক প্রস্তাব করে, স্বাধীনতার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার মূল চাবিকাঠি।"
সম্মেলনে সরকারের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, দাতা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
আটলান্টিক কাউন্সিল একটি নির্দলীয় অলাভজনক সংস্থা যেটির লক্ষ্য আন্তর্জাতিক বিষয়ে গঠনমূলক মার্কিন নেতৃত্বকে উন্নত করা। এর স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি কেন্দ্র থেকে সঠিক নীতিমালা নির্ধারণ ও সমর্থনের জন্য নিরপেক্ষতা, সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং আইনি স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্কের উপর তথ্য-ভিত্তিক গবেষণা করা হয়।
স্বাধীনতা এবং সমৃদ্ধি সূচক দুটো পৃথক সূচক যেখানে বিশ্বব্যাপী ১৬৪ দেশকে স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির মাত্রার ওপর ভিত্তি করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
সমৃদ্ধি সূচকে বাংলাদেশ
১৯৯৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সমৃদ্ধি সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যভাবে ১৩ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
তালিকায় বারবার ওঠানামা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ উন্নতি করেছে এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার আঞ্চলিক গড় পয়েন্ট থেকে ৩.৯ পয়েন্ট বেশি আছে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক গড়ের সাথেও ব্যবধান কমিয়ে এনেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুরুতে বাংলাদেশ বৈশ্বিক গড় থেকে ৯.১ পয়েন্ট পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে ৪.৮ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "এই অগ্রগতি সামগ্রিক সমৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক অগ্রগতির উপর জোর দিয়ে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে রাখছে।"
এটি বিভিন্ন উপাদানের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে 'মিশ্র' হিসেবে বর্ণনা করেছে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও বৈষম্য এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশের আরো বেশি অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আরও খারাপ হয়েছে।
সমৃদ্ধি সূচকে আয়, শিক্ষা এবং পরিবেশের মতো উপাদান রয়েছে।
আয় বাড়লেও বৈষম্য কমেনি
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে আয়ের ভালো উন্নতি হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ১৩৮তম অবস্থান থেকে ২০২২ সালে বাংলাদেশ ১১২তম স্থানে উঠে এসেছে।
গত তিন দশকে বাংলাদেশের আয়ের স্কোর ১৯.৮ পয়েন্ট বেড়েছে।
ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং আয়ের বৈষম্য কমাতে আটলান্টিক কাউন্সিল প্রগতিশীল কর নীতিমালা বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচিতে বিনিয়োগ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগের জন্য একটি সক্ষম পরিবেশ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, কর্মসংস্থানের কাঠামোগত সমস্যা সমাধান করা উচিত এবং একটি সার্বজনীন ও সমৃদ্ধশালী অর্থনীতি তৈরি করতে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা উচিত।
সূচকটি দেখায় যে অগ্রগতি সত্ত্বেও শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনও দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক গড় থেকে পিছিয়ে রয়েছে।
আটলান্টিক কাউন্সিল মনে করে, বাংলাদেশকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। শুধু সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এবং শিক্ষার প্রসার বৃদ্ধিই নয়, শিক্ষার মান উন্নয়নের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
বাংলাদেশ অতীতে পরিবেশগত গড়ের দিক থেকে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াকে ছাড়িয়ে গেলেও এখন আঞ্চলিক গড়ের নিচে অবস্থান করছে। ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু ছিল বাংলাদেশে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমার চেয়ে ১৬ গুণ বেশি।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং কাঠামোগত প্রচেষ্টার অভাব খুঁজে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশকে এ সংকট সমাধানে আইনি কাঠামো এবং আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নত করার দিকে মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে।