২৯ নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণের একমাস: চট্টগ্রামে বেশিরভাগ পণ্য বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে
মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, সবজির মতো ২৯টি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কিন্তু গত ১৫ মার্চ এই দাম নির্ধারণের পর একমাস পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে কেবল ৩টি পণ্য বাদে অধিকাংশ পণ্যের ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না সরকার নির্ধারিত মূল্য।
চট্টগ্রাম নগরীর বাজার ও সংশ্লিষ্ট দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৯ পণ্যের মধ্যে বেশিরভাগ পণ্য বিক্রি হচ্ছে নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দামে। নির্ধারিত দামের চেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে ৯টি পণ্য। কম দামে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৩টি পণ্য।
বাজারদর অনুযায়ী– পাঙ্গাশ, কাতলা, বেগুন, আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, মিষ্টি কুমড়া এবং সাগর কলা বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে।
গত ১৫ মার্চের প্রজ্ঞাপনে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭৫.৩০ টাকা, সোনালি মুরগি ২৬২ টাকা, গরুর মাংস ৬৬৪.৩৯ টাকা, খাসির মাংস ১০০৩.৫৬ টাকা, পাঙ্গাশ মাছ (চাষের) ১৮০.৮৭ টাকা, কাতল মাছ (চাষের) ৩৫৩.৫৯ টাকা এবং ডিম প্রতিটি ১০.৪৯ টাকা দরে বিক্রির জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু শনিবার (২০ এপ্রিল) চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়ি কাচাঁবাজারে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি ২৪০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩৫০ টাকা, গরুর মাংস ৯০০-১০০০ টাকা, খাসির মাংস ১১০০ টাকা, পাঙ্গাশ নাছ (চাষের) ৩০০ টাকা, কাতল মাছ (চাষের) ৬০০ টাকা এবং ডিম প্রতিটি ১২টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ডাল জাতীয় পণ্যের মধ্যে একই বাজার ও পাশের মুদি দোকানগুলোতে প্রতিকেজি ছোলা (আমদানিকৃত) ১১৫ টাকা, মসুরডাল (উন্নত) ১৪৫ টাকা, মসুরডাল (মোটা) ১১০ টাকা, মুগডাল ২০০ টাকা, খেসারিডাল ১২৫ টাকা, মাসকলাই ১৭০ টাকা এবং বেসন ১০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
অথচ সরকার নির্ধারিত দামে ছোলা (আমদানিকৃত) ৯৮.৩০ টাকা, মসুরডাল (উন্নত) ১৩০.৫০ টাকা, মসুরডাল (মোটা) ১০৫.৫০ টাকা, মুগডাল ১৬৫.৪১ টাকা, খেসারিডাল ৯২.৬১ টাকা, মাসকলাই ১৬৬.৪১ টাকা এবং বেসন ১২১.৩০ টাকা দামে বিক্রি হওয়ার কথা।
একইভাবে ১৬ মার্চ থেকে শুকনা ও মসলা জাতীয় পণ্যের মধ্যে দেশি পেঁয়াজ ৬৫.৪০ টাকা, দেশি রসুন ১২০.৮১ টাকা, আদা (আমদানিকৃত) ১৮০.২০ টাকা, শুকনা মরিচ ৩২৭.৩৪ টাকা, খেজুর (জাইদি) ১৮৫.০৭ টাকা এবং চিড়া (মোটা) ৬০ টাকা দামে বিক্রি হওয়ার কথা।
যদিও শনিবার বাজারে এসব পণ্যের মধ্যে দেশি পেঁয়াজ ৬০ টাকা, দেশি রসুন ১৯০ টাকা, আদা (আমদানিকৃত) ২০০ টাকা, শুকনা মরিচ ৪৮০ টাকা, খেজুর (জাইদি) ৩০০ টাকা, চিড়া (মোটা) ৭০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
কাজীর দেউড়িসহ নগরীর কাঁচাবাজার গুলোতে আজ প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ৩৫ টাকা, বেগুন ৮০ টাকা, আলু ৬০ টাকা, বাঁধাকপি ৫০ টাকা, ফুলকপি ১৬০ টাকা, সিম ১২০ টাকা, টমোটো ৫০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৬০ টাকা এবং সাগরকলা (হালি) ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
গতকালের প্রজ্ঞাপনে প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ৬০.২০ টাকা, বেগুন ৪৯.৭৫ টাকা, আলু ২৮.৫৫ টাকা, বাঁধাকপি ২৮.৩০ টাকা, ফুলকপি ২৯.৬০ টাকা, সিম ৪৮ টাকা, আলু ২৮.৫৫ টাকা, টমোটো ৪০.২০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ২৩.৩৮ টাকা এবং সাগরকলা (হালি) ২৯.৭৮ টাকা দরে বিক্রি হওয়ার কথা।
চট্টগাম নগরীর জামালখান এলাকার জান্নাত সুপার স্টোরের স্বত্বাধিকারী নুরুল আবছার বলেন, রমজানের শেষ সপ্তাহে পাইকারি পর্য়ায়ে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম বেড়েছে। এতে খুচরা পর্য়ায়েও পণ্যটির দাম আরো এক দফা বেড়ে গেছে। তবে গত এক সপ্তাহে ডাল জাতীয় পণ্যের দাম কিছুটা কমে এসেছে বলে জানান তিনি।
এই ব্যবসায়ী বলেন, "দাম নির্ধারণের বিষয়ে আমরা শুনেছি। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি না হলে খুচরায় আমরা কীভাবে বিক্রি করবো। সরকার যেহেতু উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সব পর্যায়ে খরচ বিশ্লেষণ করে দাম নির্ধারণ করেছে, তাই এই দাম যৌক্তিক।"
তবে এই দাম বাস্তবায়নে তদারকি সংস্থাগুলোকে কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
খাতুনগঞ্জের কাঁচাপণ্য (পেঁয়াজ, রসুন, আদা) ব্যবসায়ী সমিতি-হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিচ বলেন, "আমরাও চাই- প্রতিটি পর্যায়ে পণ্যের দাম নির্ধারিত থাকুক। কারণ আমদানিকারক কিংবা মধ্যসত্বভোগীরা আমদানি খরচের চেয়ে বাড়তি অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করে বাড়তি মুনাফা করে, অথচ বাজার মনিটরিংয়ে জরিমানা গুনতে হয় আড়তদার কিংবা কমিশন এজেন্টদের।"
উৎপাদন কিংবা আমদানি থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত শক্ত মনিটরিং হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্য়ন্ত সব পর্যায়ে দাম নির্ধারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু গত একমাসে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
এমনকি এর আগেও সরকার বিভিন্ন পণ্যের দাম বেধে দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই সাধারণ ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে সরকারে সব সংস্থা-দপ্তরগুলোকে একসাথে কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্ল্যাহ বলেন, "নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের সাথে রমজানে আমরা বিশেষভাবে বাজার মনিটরিং করেছি। এরমধ্যে সরকার আমদানি-উৎপাদন অর্থাৎ উৎস থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সব স্তরের খরচ সমন্বয় করে এই দাম নির্ধারণ করেছে। পাইকারি কিংব খুচরা কোনো পর্যায়ে এই দাম না মানার সুযোগ নেই।"
তিনি আরও বলেন, "রমজান শেষে অফিস শুরু হলো। এখন আমরা নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে সব পর্যায়ে বাধ্য করবো।"
কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ এর ৪ (ঝ) ধারার ক্ষমতাবলে গত ১৫ মার্চ ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করতা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে এই কাজ বাস্তবায়ন করবে। দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই মাঠে থাকবেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কৃষি বিপণন আইন প্রয়োগ করবেন। কৃষি বিপণন আইনে জরিমানাসহ নানান ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে।