এপ্রিলে চুয়াডাঙ্গায় এত গরম কেন?
এবারের গ্রীষ্মে সবচেয়ে তীব্র তাপপ্রবাহের মুখে পড়েছে চুয়াডাঙ্গা। গত সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় ধরেই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে এ জেলায়।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা এই প্রচণ্ড গরমের জন্য জেলাটির ভৌগোলিক অবস্থানকে দায়ী করছেন। ভারতের মধ্যপ্রদেশ থেকে গরম বাতাস (লু হাওয়া) এই অঞ্চল দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে সেই লু হাওয়া পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে শীতল হয়। ফলে তাপপ্রবাহের প্রাথমিক ধাক্কা চুয়াডাঙ্গায় পড়েছে বলে জানান তারা।
চুয়াডাঙ্গায় গত এক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকছে। অতিরিক্ত গরমের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে না। প্রচণ্ড গরমের কারণে মানুষ ঘরের বাইরে যাওয়া কমিয়ে দেওয়ায় চলাচল ও উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
যশোরেও গত কয়েকদিন ধরে চরম আবহাওয়া বিরাজ করছে। গত ২০ এপ্রিল চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল যশোরে, ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তীব্র গরমের কারণে মানুষ বাইরের কার্যকলাপ কমিয়ে দিচ্ছে। এতে বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। তীব্র তাপপ্রবাহের জেরে সরকার স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে।
এদিকে আগামী ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন ধরে দেশজুড়ে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে জানিয়ে গতকাল (২২ এপ্রিল) হিট অ্যালার্ট বা তাপপ্রবাহ সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাস দিয়েছে, এপ্রিলজুড়েই তাপপ্রবাহ থাকবে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কিছু এলাকায় বজ্রপাত ও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এতে তাপমাত্রা কমতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গায় কেন তাপমাত্রা বেশি?
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক চুয়াডাঙ্গা ও আশপাশের অঞ্চলে তীব্র গরমের কারণ হিসেবে বলছেন, এ এলাকার অবস্থান বিশ্বের অন্যতম উষ্ণ অঞ্চল ভারতের মধ্যপ্রদেশের কাছাকাছি। ওই অঞ্চল থেকে উত্তপ্ত বাতাস পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক টিবিএসকে বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিও দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহের একটি কারণ।
'এপ্রিল মাসে পৃথিবীর অবস্থানের কারণে উত্তরের গ্রীষ্মমণ্ডল সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। তাই এই অঞ্চলে বছরের এই সময়ে তাপপ্রবাহ বেশি থাকে,' বলেন তিনি।
আবুল কালাম মল্লিক আরও বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে এপ্রিলে দেশের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ থাকছে। আর প্রতি বছরই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আগের বছরের রেকর্ড ভাঙছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনও এর জন্য দায়ী।'
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ভূগোলের অধ্যাপক ড. মো. জাকারিয়াও বলেন, চুয়াডাঙ্গা কর্কটক্রান্তি রেখার নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এ এলাকায় তীব্র সূর্যকিরণ পড়ে। এছাড়া জলাভূমি কম থাকা এবং বাস্তুতন্ত্র কমে যাওয়ায় এই অঞ্চল তীব্র তাপের প্রতি আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।
ভূতত্ত্ববিদ হানিয়ুম মারিয়া খান চুয়াডাঙ্গার ভৌগোলিক অবস্থান ও গ্রীষ্মণ্ডলীয় জলবায়ুকে জেলাটির তাপমাত্রা বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কর্কটক্রান্তি রেখার কাছাকাছি হওয়ায় এলাকাটি সরাসরি সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসে। এ অঞ্চলের কম উচ্চতা ও সমতল ভূখণ্ড বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে তাপ আটকে রাখে। বাংলাদেশের মৌসুমি জলবায়ুও এ অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় তাপ সংবেদন বেড়ে যায়।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমানও বলেন, ভৌগোলিক অবস্থান, জলাভূমি কম থাকা ও কর্কটক্রান্তি রেখার কারণে চুয়াডাঙ্গায় প্রতি বছর দাবদাহ বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, শীত ও গ্রীষ্মে মহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের প্রবেশদার চুয়াডাঙ্গা। গরমের সময় ভারতের গুজরাট এলাকা থেকে উত্তপ্ত বাতাস নানা দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর ফলে চুয়াডাঙ্গা খুব কাছে হওয়ায় গরম বেশি অনুভূত হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং জলবায়ুর প্রভাব
গত বছরের এপ্রিল বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার সব রেকর্ড ভেঙে যায়। সেইসঙ্গে তীব্র তাপপ্রবাহের মুখে পড়ে সারা দেশ। সম্প্রতি দেশজুড়ে টানা ১৮ দিন মাঝারি থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে।
এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৩ বছরের মধ্যে ১৪ বছরই চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
তবে বিএমডির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে খুলনায়, ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৯৮৬ সালে চুয়াডাঙ্গার আবহাওয়া কেন্দ্র স্থাপনের আগে)।
ভৌগোলিক অবস্থান, সীমিত বাস্তুতন্ত্র, নিম্ন উচ্চতা ও সমতল ভূখণ্ড এবং মৌসুমী জলবায়ু চুয়াডাঙ্গার তাপঝুঁকির প্রধান কারণ।
চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমা বলেন, 'এ জেলায় পুকুর, নদী-নালা, জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নানাবিধ কারণে সূর্যের প্রখরতা বাড়ছে। এখন থেকে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করতে হবে সবাই মিলে।'
প্রয়োজনমতো জেলায় ঔষধি, বনজ ও ফলজ বৃক্ষ রোপণ করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তাপপ্রবাহের সঙ্গে যোগ হয়েছে পানির অভাব
চুয়াডাঙ্গায় তীব্র তাপমাত্রার কারণে তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অর্ধেকেরও বেশি নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে।
অনেকেই বাড়তি টাকা খরচ করে নতুন করে গভীর নলকূপ বসাচ্ছেন। মানুষ আগের পরিত্যক্ত কূপগুলো থেকেও পানির বিকল্প উৎস খুঁজছে।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ভ্যানচালক রবজেল হোসেন প্রতিদিনের কষ্টের বর্ণনা দিয়ে বলেন, 'রাস্তায় চলা কষ্ট। রাস্তা থেকে গরম উঠে মুখ পুড়ে যাচ্ছে। পেটের তাগিদে ঘরের বাইরে কাজের জন্য আসা। রোদ, গরম দেখলে হবে না, সংসার ও পরিবার আছে। রোদে মানুষ কম আসছে। ভাড়া নেই বললেই চলে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গাছের নিচে এসে জিরিয়ে নিয়ে আবার ভাড়া পেলে যাত্রী নিয়ে ছুটি।'
ওহিদ হোসেন নামে একজন দোকানদার জানান, গরমে তার ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। 'গরমের কারণে বিক্রি কমে গেছে। প্রতিদিন ৫-৭ লাখ টাকার মালামাল বিক্রি করতাম। এখন ১ লাখ টাকা বিক্রি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যবসা করা গরমে কঠিন হয়ে উঠছে। প্রতিদিন মনে হয় আজকে তাপমাত্রা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হবে, সকালে দোকান খুললে দেখি ভিন্ন চিত্র।'
ফল ব্যবসায়ী হারুন বলেন, 'তীব্র গরমে আঙুর, আপেল, মাল্টা, লেবুসহ অন্য ফল দোকানে রাখলেই শুকিয়ে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ৫-১০ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। গরম না কমলে ক্রেতা বাড়বে না।'
বৃষ্টি না হলে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।