তীব্র তাপদাহে কেমন কাটছে চুয়াডাঙ্গার মানুষের দিন-রাত
গরম, শীত ও বর্ষায় প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে আশাদুল হক শ্রম বিক্রি করতে আসেন চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারে। প্রায় ১৪ কিলোমিটার বাইসাইকেল চালিয়ে চুয়াডাঙ্গায় আসেন তিনি। কাজ থাকলে দৈনিক ৪০০-৪৫০ টাকা আয় করেন। কিন্তু টানা কয়েক দিনের গরমে তেমন একটা কাজ পাচ্ছেন না।
কাজ না পাওয়ায় বেশ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন আশাদুল। কারণ দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ মেটাতে গিয়ে এই তীব্র তাপদাহে নাভিশ্বাস উঠছে তার। একরকম অসহায় হয়ে পড়েছেন।
আশাদুল হকের বড় মেয়ে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে আনার্সের ছাত্রী। হোস্টেলে থাকেন। আর ছোট ছেলে দামুড়হুদা পাইলট বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। স্বামী-স্ত্রী মিলে চারজনের সংসার।
তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি গরম পড়ছে। প্রতি বছর গরম বাড়ছে। সোমবার সকালে তিনি চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার হাজরাহাটি গ্রামে একটি পানের বরজে মাটি খোঁড়ার কাজে যান। কাজ করতে গিয়ে গরমে হাঁসফাঁস অবস্থায় পড়েন। ৮ ঘণ্টা কাজ করার পর মজুরি পান ৪৫০ টাকা।
চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গা উপজেলার জামজামি গ্রামের কৃষক রেজাউল করিম। এই তীব্র গরমে জমিতে কাজ করতে পারছেন না ঠিকমতো। সূর্যের খরতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে ধান গাছ।
কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে রেজাউল বলেন, 'ভোরে মাঠে গিয়ে ধানের জমিতে কাজ শুরু করতেই সূর্য উঠছে। সূর্যের তাপে গরমে শরীর ঘেমে যাচ্ছে। বেশি সময় মাঠে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। অতিরিক্ত তাপের কারণে ধান গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলন বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। জমিতে পানি জমিয়ে রাখলেও শুকিয়ে যাচ্ছে।'
গরমে ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার হাসলামপাড়ার ভ্যানচালক রবজেল হোসেন। তিনি বলেন, 'রাস্তায় চলা কষ্ট। রাস্তা থেকে গরম উঠে মুখ পুড়ে যাচ্ছে। পেটের তাগিদে ঘরের বাইরে কাজের জন্য আসা। রোদে মানুষ কম আসছে। ভাড়া নেই বললেই চলে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গাছের নিচে এসে জিরিয়ে নিয়ে ভাড়া পেলে যাত্রী নিয়ে ছুটছি।'
প্রচণ্ড গরমে চুয়াডাঙ্গার সব শ্রেণি-পেশার মানুষেরই এই অবস্থা।
এক সপ্তাহ ধরেই চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকছে। জেলাটির ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। গত সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় ধরেই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে এ জেলায়।
অতিরিক্ত গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে চুয়াডাঙ্গার জনজীবন। মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে নেমে আসছে শুনশান নীরবতা। পেটের তাগিদে কাজের ও ব্যবসার জন্য মানুষ বাইরে বের হচ্ছেন। কিন্তু সিংহভাগ সময়ই বসে থাকছেন। স্থবিরতা নেমে এসেছে সব ক্ষেত্রে।
এই গরমের সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছে পানি সংকট। তীব্র তাপপ্রবাহে এ অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। জেলায় নলকূপ ও ইলেকট্রিক মোটরে পানি ওঠার পরিমাণ কমে গেছে একেবারেই। বহু নলকূপ ও ইলেকট্রিক মোটরে পানি ওঠাই বন্ধ হয়ে গেছে।
দামুড়হুদা উপজেলা সদরের দশমী পাড়ার আবু হাসনাত বলেন, 'আগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট মোটর চালালেই বাড়ির ছাদে এক হাজার লিটার পানির ট্যাংক পূর্ণ হয়ে যেত। প্রায় মাস দেড়েক আগে থেকে দুই থেকে তিন ঘণ্টা মোটর চালালেও প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। একইভাবে টিউবওয়েলের পানি ওঠাও বন্ধ হয়ে গেছে। সামান্য পানি উঠলেও কল চাপতে অনেক শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে বৈদ্যুতিক মোটর। ইতোমধ্যে আমার একটি মোটর পুড়ে গেছে।'
এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই রান্না ও কাপড় ধোয়ার জন্য ব্যবহার করছেন একসময়কার অব্যবহৃত কূপ বা ইঁদারার পানি।
দামুড়হুদার উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল করিম বিশ্বাস জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই টিউবয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। সামান্য কিছু টিউবয়েলে পানি উঠলেও পরিমাণে তা খুবই কম। বাধ্য হয়ে প্রায় সব বাড়িতে বৈদ্যুতিক মোটর ৮-১০ ফিট নিচে নামিয়ে পানি তোলা হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা জীবননগর শাপলাকলি পাড়ার গৃহবধু লিজা খাতুন বলেন, গরমে ছেলেমেয়েরা হাঁপিয়ে উঠছে। বাইরে বের হতে পারছে না। পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটছে।
প্রচণ্ড গরমে মন্দা যাচ্ছে ব্যবসাতেও। ক্রেতা না পেয়ে অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছেন দোকানিরা।
চুয়াডাঙ্গা বড়বাজার নিচেরবাজারের ব্যবসায়ী আবু বক্কর বলেন, 'বাজার এলাকা অনেক ফাঁকা। গরমে মানুষ খাবার কম খাওয়ায় বিক্রি হ্রাস পেয়েছে। সংসার ও দোকান খরচ মিলে প্রতিদিন ব্যয় হচ্ছে ২৫০০ টাকা। প্রতিদিন পুঁজি ভেঙে খেলে, আর গরম অব্যাহত থাকলে মাসে লোকসান হবে প্রায় লাখ টাকা।'
চুয়াডাঙ্গা ফেরিঘাট রোডের ওহিদ স্টোরের মালিক ওহিদ হোসেন বলেনন, 'গরমে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে উঠছে। প্রতিদিন ৫-৭ লাখ টাকার মালামাল বিক্রি করতাম। এখন ১ লাখ টাকা বিক্রি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।'
চুয়াডাঙ্গা চৌরাস্তা মোড়ের ফল ব্যবসায়ী হারুন বলেন, 'গরমের সাথে পেরে উঠছি না। আঙুর, আপেল, মাল্টা, লেবুসহ অন্য ফল দোকানে রাখলেই গরমে শুকিয়ে পচে নষ্ট হচ্ছে।'
হঠাৎ করে জেলায় গরম বেড়ে যাওয়ায় সড়কে মানুষের চলাচল অনেক কম। মানুষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। অনেকে গাছতলায় শুয়ে-বসে থাকছে। গরমে সব কাহিল হয়ে পড়ছে বয়সের মানুষ।
এদিকে তীব্র তাপদাহ থেকে পরিত্রাণ পেতে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের টাউন ফুটবল মাঠে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সকালে ইস্তিস্কার নামাজ আদায় করেছেন এলাকাবাসী। চুয়াডাঙ্গা জেলা সম্মিলিত উলামা কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ নামাজে অংশ নেন। নামাজ শেষে অনাবৃষ্টি থেকে মুক্তির জন্য বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন চুয়াডাঙ্গা জেলা সম্মিলিত উলামা কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আলহাজ্ব মাওলানা বশির আহমেদ।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা এই প্রচণ্ড গরমের জন্য চুয়াডাঙ্গার ভৌগোলিক অবস্থানকে দায়ী করছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, এ এলাকার অবস্থান বিশ্বের অন্যতম উষ্ণ অঞ্চল ভারতের মধ্যপ্রদেশের কাছাকাছি। ওই অঞ্চল থেকে উত্তপ্ত বাতাস পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে।
এছাড়া এপ্রিল মাসে পৃথিবীর অবস্থানের কারণে উত্তরের গ্রীষ্মমণ্ডল সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে বলে জানান তিনি। তাই এই অঞ্চলে বছরের এই সময়ে তাপপ্রবাহ বেশি থাকে।