আগাম জাতের ফুলকপি চাষে লাভ করেছেন কৃষকেরা, শীতকালীন জাতের খরচ-দাম কম
উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা শীতকালীন ফুলকপি চাষ করে এবার 'বিপাকে পড়েছেন'। আগাম জাতের ফুলকপি চাষ করে তারা আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হলেও শীতকালীন জাতের ব্যাপক উৎপাদন ও সরবরাহের কারণে দামে ধস নামায় লোকসানের আশঙ্কা করছেন তারা।
তবে, অনেক চাষি বলছেন, আগাম জাত তাদের লোকসান অনেকটাই পুষিয়ে দিয়েছে। তবে শীতকালীন ফুলকপির উৎপাদন খরচের প্রায় কাছাকাছি দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, আমন মৌসুমের শুরুতে এবার বৃষ্টিপাত হওয়ায় প্রায় সব কৃষক একসঙ্গে শীতকালীন সবজি চাষ শুরু করেন। এ কারণে এখন ফুলকপিসহ সব সবজি একসঙ্গে বাজারে এসেছে।
ফলে ফুলকপির দামে ধস নেমেছে বলে চাষিদের দাবি। তারা আরও বলছেন, আগাম জাতের কিছু চাষি ফুলকপি পরে রোপণ করেছেন, তাই উৎপাদনও দেরিতে হয়েছে। সেগুলোও এখন বাজারে আসায় দামের ওপর প্রভাব পড়েছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে কৃষকপর্যায়ে ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে তিন টাকা পিস দরে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, এর মধ্যে কিছু ফুলকপি ছিল আগাম জাতের। আবার নতুন ফুলকপি একসঙ্গে বাজারে আসায় দামে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
উত্তরের পাঁচ জেলার অন্তত ১০ জন সবজি চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫০ শতক জমিতে প্রায় পাঁচ হাজার ফুলকপির চারা রোপণ করা যায়। এ সময়ে একই পরিমাণ জমিতে চাষ, সার, কীটনাশক, শ্রমিকসহ অন্যান্য খরচ হয় ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা।
হিসাব বলছে, কৃষক পর্যায়ে একটি [শীতকালীন] ফুলকপি উৎপাদনে খরচ পড়ে তিন টাকা ৬০ পয়সা। তবে আগাম জাতের ক্ষেত্রে খরচ প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ তখন প্রতি পিস ফুলকপি উৎপাদন খরচ হয় সাত টাকার মতো। তবে বাজারে এখন ভালো মানের আগাম জাতের ফুলকপি নেই বললেই চলে।
শীতকালীন ফুলকপির দাম উৎপাদন খরচের কাছাকাছি
কৃষকেরা জানিয়েছেন, শীতকালীন জাতের ফুলকপির প্রতি পিস উৎপাদন খরচ প্রায় তিন টাকা। আর বর্তমানে পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার টাকায়।
নওগাঁ সদর উপজেলার কুমুরিয়া গ্রামের কৃষক আওরঙ্গজেব বলেন, এক বিঘা জমিতে তিনি শীতকালীন দুই হাজার ৭০০ পিস ফুলকপির চাষাবাদ করেছেন। প্রতিটি ফুলকপিতে খরচ পড়েছে তিন টাকার বেশি।
'কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার টাকা পিস হিসেবে। এতে লাভ হচ্ছে খুব সামান্য,' বলেন তিনি।
গত এক সপ্তাহ ধরে লালমনিরহাট, নওগাঁসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষকপর্যায়ে ফুলকপি বিক্রি হয়েছে দুই থেকে তিন টাকা দরে। লালমনিরহাটের কৃষকেরা বলছেন, তাদের উৎপাদন খরচের অর্ধেকও উঠছে না।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার লস্করপুর গ্রামের কৃষক রুহুল আমিন বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে ফুলকপির দাম কম ছিল। এখনো দাম কম।
'এভাবে কম দামে ফুলকপি বিক্রি করলে প্রতি বিঘায় চাষিদের ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা লোকসান হবে,' বলেন তিনি।
উত্তরবঙ্গের সবজির অন্যতম বড় পাইকারি বাজার বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থান হাট। শনিবার (৪ জানুয়ারি) শীতকালীন ফুলকপির দাম বেড়েছে মহাস্থানে।
এ দিন মহাস্থানে প্রতি মণ ফুলকপি বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৮০ টাকায়। পিসের হিসাবে প্রতিটির দাম পড়ছে সাত থেকে আট টাকা (দেড় কেজি ওজন) করে। প্রতি পিস বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে আট থেকে ১৫ টাকায়।
আগাম জাতে লাভ করেছেন কৃষক
এর আগে, অর্থাৎ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত, কৃষকেরা প্রতি পিস ফুলকপি গড়ে ৩০ টাকার ওপরে বিক্রি করেছেন। কিন্তু শীতকালীন সবজির বাজারে ব্যাপক সরবরাহ থাকার কারণে হঠাৎ করে দাম কমে গেছে।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, শীতকালীন ফুলকপির কারণে এবার লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে। তবে আগাম জাত তাদের অনেকটাই ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছে।
দিনাজপুরের রাণীশংকৈল উপজেলার কৃষক রেজাউল করিম জানান, সাত বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করে তিনি আগাম জাতের ফুলকপি থেকে প্রতি বিঘায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করেছেন। মাত্র ৬০ দিনের মধ্যেই এসব ফুলকপি বাজারজাত করা সম্ভব হয়েছে।
একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন নওগাঁ সদর উপজেলার চকজাফরাবাদ গ্রামের কৃষক শমশের আলী।
তিনি বলেন, 'আগাম জাতের ফুলকপি প্রতিপিস ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এরপর ওই জমিতে নতুন করে শীতকালীন ফুলকপির আবাদও শুরু করেছেন।'
শমশের আলী আরও বলেন, ফুলকপি মাত্র ৬০ দিনে উৎপাদন করা যায়। 'এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় রোগবালাই কম হয়েছে। তবে শীতকালীন সবজির অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে বাজারে দামের ওপর প্রভাব পড়েছে।'
দামের ওঠানামার কারণ
কৃষি অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, একই সময়ে একই ধরনের সবজির আবাদ পরিবর্তন করে ভিন্ন ভিন্ন আবাদ করলে কৃষকেরা আরও বেশি লাভবান হতে পারবেন।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাজারে সবজির ভারসাম্য না থাকলে দামের ব্যাপক ওঠানামা হয়।
'শীতকালীন ফুলকপির সরবরাহ কমে গেলে আবারও দাম বাড়বে। কৃষকেরা যদি একই ধরনের আবাদ না করে ভিন্ন ভিন্ন আবাদ করেন, তবে ভালো দাম পেয়ে লাভবান হবেন,' বলেন তিনি।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, 'এ বছর আমন মৌসুমে বৃষ্টিপাতের কারণে শীতকালীন সবজির আবাদ দেরিতে শুরু হয়। ফলে সবজি একসঙ্গে বাজারে এসেছে, যা দামের ওপর প্রভাব ফেলেছে।'
শীত মৌসুমে মহাস্থান বাজার থেকে প্রতিদিন ৭০ থেকে ১০০ ট্রাক সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।
এ বাজারের মেসার্স শাহ সুলতান ট্রেডার্সের অন্যতম মালিক পায়েল আহমেদ বলেন, কাঁচামালের বাজার মূলত নির্ভর করে সরবরাহের ওপর।
'আমদানি বেশি হলে দাম কমে, কম হলে দাম বাড়ে। বর্তমানে শীতকালীন সবজির চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে গত এক সপ্তাহের তুলনায় বাজার ভালো।'
মহাস্থান হাটের গ্রোয়ার্স মার্কেটের পরিচালক মো. আমিনুর রহমান জানান, গত পাঁচ দিন ধরে বগুড়ার মহাস্থান মোকামে সবজির দাম কম থাকলেও আজ শনিবার কিছুটা বেড়েছে।
তিনি বলেন, 'আজ শিম বিক্রি হয়েছে ২০ টাকা কেজি দরে এবং মুলা প্রতিমণ ২৫০ টাকায়। সবকিছু মিলিয়ে কৃষকরা এবার ক্ষতির মুখে পড়বেন না বলে আশা করা যাচ্ছে।'
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'বাজারে সবজির ভারসাম্য বজায় রাখতে কৃষকদের পরিকল্পিত আবাদে মনোযোগী হতে হবে। কৃষি বিভাগ এ বিষয়ে সচেতন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে।'
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় চলতি বছর শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে, যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ছয় হাজার ৪৫০ টন। এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।