ইমাম বাটনের ‘লাভজনক’ মাছের খামারে মাছই নেই
গত বছর বোতাম ব্যবসা থেকে মাছ ও ট্যানারির ব্যবসায় রূপান্তরিত হয় ইমাম বাটন। তবে কোম্পানিটির পুকুরে কোনো মাছ পাওয়া যায়নি। আর এর জুতার কারখানায় দিনে ২০ জোড়ার বেশি জুতা তৈরি হচ্ছে না।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি মাছ ব্যবসার জন্য কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি এবং ব্যবসার শুরুতে ট্যানারি ইউনিটের দেওয়া ডিসক্লোজারটি 'মিথ্যা ও ভুল তথ্যপূর্ণ'।
তবে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথমার্থে (জুলাই–ডিসেম্বর) কোম্পানিটি মাছ বিক্রি থেকে এক কোটি ১৪ লাখ টাকা আয় এবং ১৩ লাখ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে। এটি মুনাফা থেকে শেয়ারধারীদের ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশও দিয়েছে।
কোম্পানির কর্মকর্তারা অবশ্য কোনো অন্যায়ের কথা অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, ডিএসই'র পরিদর্শক দল তাদের পরিদর্শন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিচালনা করেনি। তারা বলেছেন, কোম্পানিটি সবেমাত্র কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।
২০১৮–১৯ অর্থবছরে ইমাম বাটনের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এক্সচেঞ্জ কমিশনের তত্ত্বাবধানে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। কোম্পানির শেয়ার অধিগ্রহণের পর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন এএসএম হাসিব হাসান।
তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বোতাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইমাম বাটন পরে আগস্ট মাসে কৃষি প্রকল্পে কার্যক্রম প্রসারিত করার মাধ্যমে পুনরায় উৎপাদন শুরু করে। ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে নিজস্ব কারখানায় ট্যানারি ব্যবসার সূচনা করে এটি।
চট্টগ্রামভিত্তিক ইমাম গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইমাম বাটন ২৪ মার্চ 'HAMI' ট্রেড কোডের মাধ্যমে এর নাম পরিবর্তন করে হামি ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি-তে পরিণত হয়। এর খাতটিও 'ফার্মাসিউটিক্যালস ও কেমিক্যালস'-এর পরিবর্তে 'বিবিধ'-এ পরিবর্তিত হয়েছিল।
এছাড়া কোম্পানিটির জেড ক্যাটাগরি থেকে বি ক্যাটাগরিতে পরিবর্তনও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিভাগ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া অনুমোদনের জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ গত মাসে ইমাম বাটনের জুতা কারখানা এবং মৎস্য প্রকল্প পরিদর্শন করে। পরিদর্শন প্রতিবেদনটি ২৬ মার্চ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) জমা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে মাছ ব্যবসা
বর্তমানে হামি ইন্ডাস্ট্রিজ নামধারী ইমাম বাটন কৃষি প্রকল্পে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে মাছ চাষ ও কোয়েল পাখি পালনে এক কোটি টাকা এবং পুকুর ইজারা নিতে ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবর–নভেম্বরে মাছের পোনা কিনে সেগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে বিক্রি করা হয়েছে বলে দাবি করেছে কোম্পানিটি।
তবে মাত্র দুই মাসের মধ্যেই ছোট মাছ বিক্রিযোগ্য হওয়াকে সামঞ্জস্যহীন বলে মনে করেছে ডিএসই'র পরিদর্শন দল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সংস্থাটি মাছ বিক্রি এবং ফিড ক্রয়ের জন্য কোনো নথি দেখাতে পারেনি। সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরেও ফিড, কোয়েল পাখি এবং মাছের পোনা কেনাকাটা সম্পর্কিত কাগজপত্রের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি ডিএসই।
এছাড়া আট বিঘা জমির ওপর কাটা পুকুরটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম হাসিব হাসান ইমাম বাটনকে মাসে এক লাখ টাকায় ইজারা দিয়েছেন।
ডিএসই এর প্রতিবেদনে বলেছে, জমির ইজারার হার বাজারদরের চেয়ে বেশি।
প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় হাসিব হাসান বলেন, তারা বিদ্যমান কৃষি প্রকল্পে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে মাছ বিক্রি করেছেন। পুকুরে মাছ না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, 'পরিদর্শন টিম তো পানিতে নামেনি, জাল দিয়েও পরীক্ষা করেনি। তাই তাদের অনুসন্ধান সঠিক নাও হতে পারে।'
মাছ বিক্রির ভাউচার না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের এলাকায় মাছ বিক্রিতে নগদ লেনদেন সাধারণ বিষয়। বিক্রির টাকা কোম্পানির ব্যাংক হিসেবে রাখা হয়েছে এবং সে তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জকে দেওয়া হয়েছে।
মাছের পোনা কেনা প্রসঙ্গে হাসিব হাসান বলেন, তারা আগের মাছ বিক্রি করে নতুন পোনা কিনে ছেড়েছেন। তিনি আরও বলেন, 'আমরা বন্ধ থাকার পর এখন উৎপাদন চালু হয়েছে। আগামীতে কোম্পানির গ্রোথ [প্রবৃদ্ধি] আরও বেশি হবে।'
প্রতিবেদনে ট্যানারি ব্যবসা
ডিএসইতে একটি ডিসক্লোজারে কোম্পানিটি বলেছে, এটির জুতা কারখানা প্রতিদিন ৫৩০ জোড়া জুতা এবং বছরে এক লাখ ৬০ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন করতে পারে। এটি ট্যানারি ইউনিটের জন্য ২৫ কোটি টাকার প্রত্যাশিত বার্ষিক টার্নওভার এবং দুই কোটি টাকা লাভের দাবি করেছে।
তবে কারখানা পরিদর্শন করে ডিএসই'র পরিদর্শন দল দেখতে পায়, দাবি করা উৎপাদন সক্ষমতা মিথ্যা। কারখানাটি প্রতিদিন মাত্র ১৫–২০ জোড়া জুতা উৎপাদন করতে পারে।
পরিদর্শন দলটি বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে বছরে দুই কোটি টাকার প্রত্যাশিত মুনাফাকেও অবাস্তব বলে মনে করেছে। এছাড়া দলটি বলেছে, প্রদত্ত তথ্য এবং নথিপত্রের বেশিরভাগই 'ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর' বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মূল্য-সংবেদনশীল তথ্যে মিথ্যা বা জাল তথ্য প্রকাশ লিস্টিং রুলসের ৪৫ ধারা ও সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন।
ট্যানারির উৎপাদন ক্ষমতা প্রসঙ্গে হাসিব হাসান বলেন, পরিদর্শনের দিন কারখানায় জুতা তৈরির প্রায় ৩০ জন শ্রমিক ছিলেন। 'কীভাবে দিনে ১৫–২০ জোড়া জুতা তৈরি হয় বলে [পরিদর্শক দল] মত দিয়েছে, সেটা বোধগম্য নয়,' বলেন তিনি।
শেয়ারের দামের উল্লম্ফন
২০২১ সালের জানুয়ারিতে ইমাম বাটনের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ২০ টাকা, যা ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ টাকায়। স্থবির আয় এবং উৎপাদন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ছয় মাসের ব্যবধানে ২০২২ সালের ১২ জুলাই শেয়ারের দাম সাড়ে ছয় গুণ বেড়ে ১৫৬ টাকায় উন্নীত হয়।
প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালে আগস্ট মাসেও উৎপাদনে ফিরতে না পারায় ওইসময় শেয়ারের দাম কিছুটা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১২৮ টাকা ৪০ পয়সায়।
তবে ১০ আগস্ট এক ঘোষণায় কোম্পানিটি বোতাম ব্যবসা থেকে বেরিয়ে মাছ চাষের বিনিয়োগ করবে জানানোর পর বছরের ২৩ নভেম্বর শেয়ারের দাম কোম্পানিটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২২০ টাকায় উঠে। বর্তমানে এটির শেয়ারের মূল্য ১৬৬ টাকা।
স্বল্প মূলধনী কোম্পানি হামি ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার সংখ্যা ৭৭ লাখ, যার ৩৪ শতাংশ মালিকানা এটির মালিক এবং নতুন শেয়ারধারীদের।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুর্বল কিংবা লোকসানি কোম্পানিগুলোকে সচল করতে সহায়তা করছে কমিশন। তবে কমিশনের এ সহায়তার সুযোগ নিয়ে শেয়ার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়তে পারে নতুন মালিকরা।
ব্যবসা বা আয়ে কোনো দৃশ্যমান উন্নতি না হওয়ায় এ মালিকানা কাঠামোর কারণে শেয়ারের দামে হেরফের হচ্ছে বলে তারা সন্দেহ করছেন।
যে কারণে ইমাম বাটন কার্যক্রম বন্ধ করেছিল
ইমাম বাটন ইন্ডাস্ট্রিজ ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ঋণ খেলাপির জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা ৫৫টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইমাম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী জেবুনেসা আক্তার সংযুক্ত আরব আমিরাতে পালিয়ে যান।
ইমাম বাটনে মোহাম্মদ আলী ১৮ দশমিক ১১ শতাংশ এবং জেবুনেসা আক্তার ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ারের মালিক। মালিক দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কোম্পানিটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইমাম গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
গ্রুপের কর্তাব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে আনা কিংবা বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের জন্য আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও এখনও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
প্রশ্নের মুখে লভ্যাংশ প্রদান
ইমাম বাটন কেবল এটির সাধারণ শেয়ারধারীদের ১ শতাংশ অন্তর্বর্তীকালীন নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার পরে ডিএসই দেখতে পায়, কোম্পানিটি ঋণব্যয় সামঞ্জস্য না করে মুনাফা দেখানো এবং তার ভিত্তিতে লভ্যাংশ প্রদানসহ ডজনখানেক ক্ষেত্রে স্টক প্রবিধান মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে কোম্পানির কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ডিএসই বলেছে, প্রাইম ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্টের চার কোটি ৮৩ লাখ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে ইমাম বাটনের কাছে। এর মধ্যে চার কোটি ৩৭ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং ৪৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা স্বল্পমেয়াদি ঋণ।
ডিএসই উল্লেখ করেছে, ইমাম বাটন কেবল তার সাধারণ শেয়ারধারীদের জন্য ১ শতাংশ অন্তর্বর্তী নগদ লভ্যাংশ প্রদান করেছে, যা এক্সচেঞ্জ কমিশনের ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জারি করা আদেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ডিএসই'র অনুসন্ধান অনুযায়ী, কোম্পানিটি এটির ঋণ ও অন্যান্য আর্থিক খরচ এটির লাভ-লোকসানের হিসেবে বিবেচনা করেনি। যদি এসব খরচ ধার্য করা হয়, তাহলে ইমাম বাটনের নিট মুনাফা নেতিবাচক হবে এবং অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ ন্যায়সঙ্গত হবে না।