তাপপ্রবাহ শিক্ষার্থীদের দূরে রাখছে: স্কুল খোলা রাখায় বাধা হয়ে উঠেছে কম উপস্থিতি, অসুস্থতা
ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রিমঝিম। বাড়ি যাওয়ার জন্য স্কুল প্রাঙ্গনে ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। যদিও প্রচণ্ড গরমে ঘামছিল রিমঝিম, তারপরও সে জানাল যে গরমে সে মোটেও বিরক্ত নয়। কারণ এক সপ্তাহ বন্ধ শেষে সে স্কুলে ফিরতে চেয়েছিল।
রিমঝিম বলে, 'আমি অফলাইন ক্লাস করতে পছন্দ করি। আমি ক্লাসে ফিরতে উতলা ছিলাম। কিন্তু আমার বেশিরভাগ বন্ধুই ক্লাসে আসেনি।'
একই স্কুলের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী সাউদা বলছিল, জলবসন্তে আক্রান্ত তার জমজ বোনসহ অনেক সহপাঠীই ক্লাসে আসেনি।
সে বলে, 'প্রচণ্ড গরম। আমি এসেছি কারণ একটি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। আমি আগামীকাল আসব না।'
এক সপ্তাহ বন্ধের পর আজ সারা দেশের স্কুল ও কলেজ খুললেও কম উপস্থিতি ছিল একটি সাধারণ বিষয়।
রাজশাহীর বিসিএসআইআর ল্যাবটেরী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬০১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম দিনে উপস্থিত ছিল মাত্র ১০০ জন।
খুলনার সরকারি ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফারুকুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ হলে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী এক হাজার ৮০০ জন। আজ এক হাজারের মতো শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।'
কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশেদা আক্তার জানান, অন্যান্য সময়ে সাধারণত ৮৫-৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। রবিবার প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। অনুপস্থিত ছিল প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী। গরমের কারণে উপস্থিতি কমে গেছে।
তবে যেসব স্কুলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি ছিল।
যেমন, নারায়ণগঞ্জের বিদ্যানিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ে উপস্থিতি ছিল ৮০ শতাংশ।
স্কুলটিতে প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম থাকলেও অন্যান্য শ্রেণিতে উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি ছিল।
স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটির সদস্য আবদুস সালাম বলেন, 'গরমের কারণে শিক্ষার্থীদের বাসা থেকে পানি নিয়ে আসা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতি ঘণ্টার ক্লাসে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের পানি পান করার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্কুল ইউনিফর্মের বাইরেও পাতলা সুতির জামা পরে আসারও অনুমতি দেওয়া হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের মোট এক হাজার ৯০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০০ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল।'
'এখন স্কুল খোলা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়'
তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে স্কুল খোলা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে।
শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী রাশেদা কে চৌধুরী টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ''যেকোনো শিক্ষাগত ঘাটতি পূরণের জন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ মুহূর্তে স্কুল খোলা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।''
তিনি অবশ্য বলেন, স্কুল বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ''এটি বন্ধ করা দরকার। আমাদের শিক্ষকদের জন্য নীতিমালা নিয়ে আসা দরকার, যাতে তারা পরবর্তী সময়ে যথাযথভাবে ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করতে পারেন।''
সারা দেশে তাপ প্রবাহের কারণে প্রায় ৩৫ জন মারা গেছেন। এ কারণে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ওপর তাপপ্রবাহের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কিছু প্রভাব ইতোমধ্যে দেখাও গেছে।
যেমন, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় তাপমাত্রা প্রায় ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠেছে। সেখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১৭ জন শিক্ষার্থী গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
একই ঘটনা ঘটেছে মুন্সীগঞ্জেও।
আজ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, কোনো জেলায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে, সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে।
অনলাইন ক্লাস কি সমাধানের উপায়?
ভিকারুননিসা স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শেরিন সুলতানাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। তিনি জানতেন যে এই গরমে তার সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু স্কুলে না গেলে তার সন্তান অ্যাকাডেমিকভাবে পিছিয়ে পড়বে। তাই সন্তানকে নিয়ে এসেছেন।
শেরিন সুলতানা বলেন, ''যখন স্কুল বন্ধ থাকে, তখন শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় খুব কম মনোযোগ দেয়। বন্ধের ফলে একটি গ্যাপ তৈরি হয় এবং শিক্ষা ব্যাহত হয়। আমরা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, তবে আমি মনে করি সিলেবাস শেষ করার জন্য এখন অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজন।''
দিল্লি পাবলিক স্কুল সোসাইটির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শ্রীপোলা তানজম জানান, এখন অনলাইনে ক্লাস হলেই ভালো হতো।
তিনি বলেন, ''এই গরমে অনলাইন ক্লাসই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। তাপপ্রবাহের কারণে শিক্ষার্থীদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। এখন ঘরে থাকা এবং অনলাইন ক্লাস করাই ভালো হবে। আমার মেয়ে অনলাইনে ক্লাস করছে। সে স্কুলে যেতে চায়, কিন্তু এই গরম অসহনীয়।''
তবে অনলাইন ক্লাসের কথা বলাটা সহজ হলেও বাস্তবায়ন করাটা ততোটা সহজ নয়।
২০২৩ সালের এডুকেশন ওয়াচের সমীক্ষা বলছে, প্রাথমিকের প্রায় ৪১ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ৫৮ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থীর প্রাথমিকভাবে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
এর পরও শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার ও শিক্ষকদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সঠিক প্রতিফলন দেখা যায়নি।
৬ষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক অনুপমা আশিকা বলেন, ''আমার মেয়ের স্কুল বন্ধ। তাই ওকে নিজে নিজেই পড়াশোনা করতে হয়। তবে ক্লাসে থাকা এবং মনযোগ দিয়ে শিক্ষকদের কথা শোনাই বেশি ভালো।''
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্রী সানিয়া জানান, অনলাইন ক্লাসের চেয়ে অফলাইন ক্লাস করা ভালো।
তিনি বলেন, ''আমার পরীক্ষার আর এক মাস বাকি। গরমের কারণে আমরা অনলাইনে ক্লাস করছি। কিন্তু অফলাইনে ক্লাস করার সময় আমি ভালো বুঝি।''
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ''অনলাইন ক্লাস হলে আমরা সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারছি কি না, সেটি ভাবনার বিষয়। ইতোমধ্যেই মহামারির সময় আমরা সংকট দেখেছি। সবার জন্য অনলাইন ক্লাস করা কঠিন।''
তিনি চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে স্কুল বন্ধের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, ''এমন প্রতিকূল পরিবেশে আমরা আমাদের সন্তানদের বিপদে ফেলতে পারি না।''
২০২১ সালে ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরেকবার বন্ধের কারণে ৩৭ মিলিয়ন স্কুলপড়ুয়া শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছিল।
এ সময় বেশ কিছু শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘায়িত তাপপ্রবাহ একাডেমিক কার্যক্রমকে আরও ব্যাহত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ ও নোয়াখালী প্রতিনিধি।