আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ৬ বছর ধরে বন্ধ বাংলাদেশের একমাত্র রেলওয়ে জাদুঘর
বাংলাদেশের রয়েছে রেলের সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের সাক্ষী বহন করতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল দেশের একমাত্র রেলওয়ে জাদুঘর। তবে বর্তমানে জাদুঘরটি রয়েছে বেহাল অবস্থায়।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত রেলওয়ে জাদুঘরটি একসময় নানা নিদর্শনে সমৃদ্ধ ছিল। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জাদুঘরটি বর্তমানে ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে।
জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০০৩ সালে। এতে ব্রিটিশ যুগ থেকে সময়ের বিবর্তনে রেলের যন্ত্রপাতি, স্মৃতিচিহ্ন ও সরঞ্জামের সংগ্রহ রয়েছে। যার মধ্যে কয়লা-চালিত ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, সিগন্যাল লাইট ও ইউনিফর্মগুলি কৌতূহলী দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
তবে ২০১৮ সালেই আচমকা বন্ধ হয়ে যায় জাদুঘরটি। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সংবাদদাতার সাম্প্রতিক পরিদর্শনে এর নাজুক অবস্থা দেখা যায়। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের এক মনোমুগ্ধকর নিদর্শন দোতলা কাঠের বাংলোর জাদুঘরটি এখন অবহেলিত।
ভবনটির প্রবেশদ্বারে আগাছা জন্মেছে এবং তালায় মরিচা ধরেছে। ভেতরের মূল দরজাটি খুলতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কেননা বহুদিন তা ব্যবহার না করায় মরিচা ধরেছে।
চারটি প্রশস্ত কক্ষে রেলওয়ের ধ্বংসাবশেষের সংরক্ষণ করা হয়েছে। রেললাইনগুলি ধুলোমাখা কাপড়ে মোড়ানো, সিগন্যালিং সরঞ্জাম, যোগাযোগের সরঞ্জাম ও স্টেশন মাস্টারদের ক্যাপ ইত্যাদিতে অবহেলার ছাপ স্পষ্ট।
কক্ষের ম্লান আলো প্রত্নবস্তুগুলিকে আলোকিত করেছিল। আর বাকিসব প্রত্নবস্তুগুলি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা ছিল। একইসাথে কবুতরের বিষ্ঠার দুর্গন্ধ বাতাসে ভেসে উঠছিল।
স্থানীয়রা জাদুঘরটি যখন ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ ছিল সেই সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করেন। ঠিক তেমনি এক দর্শনার্থী প্রকৌশলী হাবিব উল্লাহ দুঃখ করে বলেন, "আমাদের রেলওয়ের ঐতিহ্য বোঝার জন্য জাদুঘরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি লজ্জার বিষয় যে, এখন এখানে তরুণ প্রজন্ম যেতে পারে না।"
মোহাম্মদ ইউনুস সিকদার ১৪ বছর ধরে জাদুঘরটির প্রহরী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি আগের প্রাণবন্ততার কথা স্মরণ করে বলেন, "তখন জাদুঘরটি বিকাল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকতো। এখানে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ জন দর্শক আসতেন।" দুঃখজনকভাবে এখন জনমানবশূন্য এই জাদুঘরটি পাহারা দিয়েই তার দিন কাটছে।
জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত রেলওয়ের কর্মকর্তা আতিকুর রহমান সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
এক্ষেত্রে জাদুঘরটি নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করেছেন। এই বিষয়ে বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম দায় অস্বীকার করে বলেন, "এই জাদুঘরটি পরিপূর্ণ নয়। তাছাড়া এটি আমাদের নিয়ন্ত্রণেও নেই।"
শেখ রাসেল শিশু পার্কের অংশ হিসেবে জাদুঘরটির মাঠ দখলের অভিযোগ তুলে সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দিকে আঙুল তোলেন। তবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কর্পোরেশনের সিইও তৌহিদুল ইসলাম স্পষ্ট করে বলেন, "ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল; এখন সমাধান হয়েছে। বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে একটি যৌথ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে।"
এমন সব জটিলতার মাঝে জাদুঘরটির ভবিষ্যৎ যেন অনিশ্চিত। ঐতিহাসিক সব প্রত্নতত্ত্বগুলো ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় পড়ে আছে এবং জনসাধারণকে দেশের ইতিহাসের মূল্যবান সব বস্তু দেখা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
যদিও ব্যবস্থাপনা কমিটি আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে এটা স্পষ্ট নয় যে, একসময়ের গর্বিত এই রেলওয়ে জাদুঘরটি আবার কবে খুলবে এবং দেশের রেলওয়ে ঐতিহ্যের ভাণ্ডার হিসাবে নিজের জায়গা পুনরুদ্ধার করবে।