ঢাকায় গরম কি কমানো সম্ভব?
গত বছরের জুলাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উত্তপ্ত মাস। আর মাত্র মাস দুয়েক পরেই বোঝা যাবে এবছরের জুলাইয়ে গরম কেমন পড়বে। অবশ্য এরমধ্যে তাপদাহে দগ্ধ হচ্ছে এশিয়ার নগর-বন্দর। কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছে ঢাকায়। আর তীব্র তাপদাহের কবলে থাকা চুয়াডাঙ্গা গত দুই সপ্তাহ ধরে দেশের সবচেয়ে উষ্ণ জনপদ।
কেবল এশিয়া বা আফ্রিকা নয়, বিশ্বের প্রায় সব নগর জনপদই উষ্ণতর হয়ে উঠছে। আগামী ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর দুই গোলার্ধেই গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে এই পূর্বাভাস গড় তাপমাত্রার, কিন্তু শহরগুলোয় এরমধ্যে তার চেয়ে উচ্চ তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে।
ঢাকায় তাপমাত্রার পারদ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু শহরে যা ছাড়িয়েছে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শহরগুলোকে তাপ-নিরোধী করা সম্ভব নয়, তবে উত্তাপ কমানোর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। তীব্র তাপের দহন থেকে নগরবাসীদের সুরক্ষা দিতে বিশ্বব্যাপী নানান প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হচ্ছে। তাপমাত্রার তীব্রতা যতই বাড়ছে, উদ্যমী নগর কর্তৃপক্ষগুলোও তার সাথে তাল মিলিয়ে শহরকে ঠাণ্ডা রাখা বা তাপ প্রশমনের নানান উপায় খুঁজছে। যেমন কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে দুবাই। অন্যদিকে, অন্যান্য এশীয় শহরের মতো সড়কে স্প্রে করে পানি ছেটানো শুরু করেছে ঢাকা।
এর মধ্যে কিছু উদ্যোগ তাপদাহের সময়ে নগরবাসীকে সাময়িক স্বস্তি দেওয়ার জন্য, অন্যগুলো হলো দীর্ঘমেয়াদি।
বিশ্বের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ তাঁদের শহরের তাপমাত্রা কমাতে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, বা কৌশলকে কাজে লাগাচ্ছেন তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো।
তাপ-নিয়ন্ত্রণে পানির ব্যবহার
তাপমাত্রার প্রকোপ কমাতে বহু শতাব্দী ধরে পানিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। ১৩ শতকে নির্মিত স্পেনের আলহামরা প্রাসাদের অন্তঃপুরের পরিবেশ শীতল রাখতে পুল ও ফোয়ারা ব্যবহার করা হয়েছে।
উত্তাপ কমাতে আজো পরিত্রাতা হচ্ছে পানি। কিন্তু, গত এক শতকে ঢাকা শহরের প্রাকৃতিক জল-শীতাতপ ব্যবস্থাকে ধবংস করা হয়েছে। নদীগুলোকে আমরা দূষিত করে ফেলেছি, খালগুলো দখলে-দূষণে বিলুপ্ত হয়েছে, আর পুকুর-ডোবা-জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল সব অট্টালিকা। তাই এখন ওয়াসার মূল্যবান পানি ছেটাতে হচ্ছে শহরের রাজপথে।
প্রায় পরিত্যাক্ত কিছু পার্ক ও খেলার মাঠ পুনরুদ্ধারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে সাহায্য করেছিলেন স্থাপত্যবিদ রফিক আজম। তিনি জানান, কোনো ল্যান্ডস্কেপের নকশা করার ক্ষেত্রে তিনি সবসময় তাঁর কেন্দ্রে একটি পানির উৎস রাখেন। এটা শুধু তাপ প্রশমনের জন্যই নয়, বরং আশেপাশের গাছপালা, মানুষজন ও পাখিদের পানির প্রয়োজনের কথা ভেবেও করেন।
ঢাকার তাপমাত্রা যখন ৩৯ ডিগ্রি বা তাকেও ছাড়িয়ে যায়– রাস্তাঘাটে চলাচলকারীদের সূর্যের প্রখর উত্তাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি দিতেই নির্দিষ্ট কিছু সড়কে পানি স্প্রে করার এক কর্মসূচি নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
সড়কে জলকামানের মাধ্যমে এই কৃত্রিম বৃষ্টির উদ্যোগ দেখে বিস্মিত ও আনন্দিতই হন নগরীর আগারগাঁওয়ের বাসিন্দারা।
ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, পানি স্প্রে করার জন্য দুটি যন্ত্র ব্যবহার করছেন তারা। প্রতিটি গাড়ি প্রতিদিন প্রায় ৪ লাখ লিটার পানি স্প্রে করতে পারে। ঢাকা দক্ষিণ সিটিও তাদের পানি ছিটানোর উদ্যোগ জোরালো করেছে।
এই গাড়িগুলোর ওপরে বড় আকৃতির ফগ গান থাকে, যা থেকে স্প্রে করা হয় জলকণা। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে গ্রীষ্মকালে এভাবে পানি ছেটানো একটি সাধারণ বিষয়। দুই বছর আগে চীনে যখন তাপমাত্রা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল – সেসময়য় দেশটির হাংঝৌ, উহান ও চনকিং এর মতো বৃহৎ মহানগরে এসব ফগ ট্রাকের মাধ্যমে পানি ছেটানো হয়েছে।
উত্তরের মেয়র আতিকুল জানান, চিফ হিট অফিসারের বিভিন্ন সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বাস্তবতায় নগর জনপদে যেসব জনদুর্ভোগ দেখা দিতে পারে তা দীর্ঘদিন ধরেই জানা, তবে এটি মোকাবিলার জন্য একেবারেই অপ্রস্তুত যেসব শহর তারমধ্যে ঢাকা অন্যতম। তাপদাহের ফলে শহরাঞ্চলে 'হিট আইল্যান্ড' নামক যে প্রভাব তৈরি হয় – তা কমাতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়াকে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষাও করা হয়েছে। এতদিন পর তা বুঝতে পারছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপে নগরবাসীর যখন দমবন্ধ অবস্থা, তখন বিশ্বের অন্যান্য শহরের মতো ঢাকাও 'চিফ হিট অফিসার নিয়োগ' দিয়েছে এবং 'হিট অ্যাকশন প্ল্যান' প্রণয়নের জন্য তাদের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে।
গত বছরের মে মাসে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) আর্শট-রক ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় একটি শহুরে তাপ স্থিতিস্থাপক প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশের প্রথম 'চিফ হিট অফিসার' (সিএইচও) হিসেবে বুশরা আফরিনকে নিয়োগ দেয়। অন্যান্য কিছু বিদেশী শহরও একই কর্মসূচির অধীনে সিএইচও পেয়েছে।
এই কর্মসূচির অধীনে তাপমাত্রা কমাতে দুই লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি। ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল নগরবাসীকে তাঁদের আশাপাশের গাছপালার যত্ন নিতেও অনুরোধ করেন। তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের পার্ক ও খেলার মাঠে 'কৃত্রিম বৃষ্টি' (এখানে তিনি পানি ছেটানোকে এভাবে বলেছেন) তৈরির নির্দেশ দেন।
এমন সময়ে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে – যার আগেই ধবংস করা হয়েছে ঢাকার সবুজ আচ্ছাদন। নগরীর বেশিরভাগ খালের অস্তিত্ব রয়েছে শুধু পুরোনো মানচিত্রে।
নগর এলাকায় তাপ-নিয়ন্ত্রণে অপরিহার্য হচ্ছে – উদ্যান, খেলার মাঠ, বা শহরের টিকিয়ে রাখা বন। গত তিন দশকে ঢাকা উত্তর সিটিতে যা ৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে ২০২৩ সালের এক গবেষণাসূত্রে জানা গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরহাদুর রেজা ছিলেন এই গবেষণার অন্যতম গবেষক। তিনি বলেন, "দিনকে দিন যেভাবে ঢাকার সবুজ অংশ কমছে, তাতে কিছুদিন পরে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ঢাকা উত্তর সিটির চেয়েও কম সবুজ অংশ রয়েছে ঢাকা দক্ষিণের। এই অবস্থায়, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির সুফল পেতেও নগরবাসীকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। ততোদিন তীব্র গরমের দিনগুলোত পানি ছিটানোর মতো অস্থায়ী পদক্ষেপগুলোই একমাত্র উপায়। কারণ যেসব পুকুর ও খাল-বিল হারিয়ে গেছে, সেগুলো আর কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব না।"
এছাড়া, অন্যান্য বড় শহরগুলোর মতো আরো কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে ঢাকার দুই নগর কর্তৃপক্ষ।
ছাউনির ব্যবস্থা
পথচারী ও খরিদ্দারদের তীব্র রোদ থেকে রক্ষা করতে কাপড় বা ক্যানভাসের তৈরি ছাউনি টাঙ্গানোর ব্যবস্থা করতে পারে নগর কর্তৃপক্ষ বা মার্কেট সমিতিগুলো। সড়কের উভয় পাশের ভবনগুলোর সাথে এ ধরনের ছাউনি স্থাপন করা যেতে পারে।
সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্পেনের সেভিল ও ইসরায়েলের তেল আবিব – স্কুল, খেলার মাঠ, হাসপাতাল ও বাণিজ্যিক এলাকাসমূহে এই ধরনের ছাউনির ব্যবস্থা করে সুফল পেয়েছে।
ভ্রাম্যমাণ পুল ব্যবহার
উদ্যান, খেলার মাঠ ও অন্যান্য পাবলিক স্পেসে সহজে বহনযোগ্য রাবারের পুল স্থাপন করতে পারে নগর কর্তৃপক্ষ। তীব্র গরম থেকে স্বস্তি পেতে নাগরিকরা এসব জলাধারে গোসল করতে বা হাতমুখ ধুতে পারবে। এই উদ্যোগ যুক্ত হতে পারে বাণিজ্যিক সংস্থা, বিভিন্ন ধরনের ক্লাব বা সামাজিক সংগঠন।
সড়কের উভয়পাশে গাছ রাখা
রমনা বা হাতিরঝিলের মতো জায়গার বড়ই অভাব নগরবাসীর, যেখানে সড়ক ও ফুটপাতে থাকবে গাছের ঘন ছায়া। ৩০০ ফুট নামে পরিচিত নবনির্মিত কুড়িল-পূর্বাচল সড়ককে এভাবে বৃক্ষশোভিত করা যায়। সড়কের আইল্যান্ডে বা উভত পাশে গাছ লাগিয়ে গত কয়েক বছরে বড় রুপান্তর করেছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন।
পৌর কর্তৃপক্ষটি গাছ লাগিয়ে পদ্মা নদীতীর রক্ষা করেছে, গাছের ছায়ায় তৈরি করেছে পায়ে চলার দীর্ঘ পথ। বর্তমানে ৪০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রার কবলে রয়েছে রাজশাহী, শহরটিতে বৃক্ষ আচ্ছাদন কম হলে– গরম আরো ভয়াবহ হতো।
প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে টেকসই এ উপায় অনেক শহরই গ্রহণ করেছে। অন্যান্য কিছু উপায়ও আছে, কিন্তু বাস্তবায়নের সময় ও অর্থের বিবেচনায় সেগুলো এই মুহূর্তে ঢাকার জন্য প্রযোজ্য নয়।
নগরীর ভৌগলিক অবস্থান, স্থানীয় আবহাওয়া পরিস্থিতি অনুযায়ী অবকাঠামোর নকশা ও নির্মাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ঢাকা শহর যেভাবে গড়ে উঠছে, যেসব নির্মাণসামগ্রী ও নকশা অনুসারে তা করা হচ্ছে – এতে প্রতিনিয়তই আরো উষ্ণতা বাড়ছে শহরের। এজন্য স্থাপত্য ও প্রকৌশলগত ক্ষেত্রে সংস্কার চাই। ঢাকার দুই নগর কর্তৃপক্ষের কাছে এই সমাধান বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য মনে নাও হতে পারে। তবে মনে রাখা দরকার, এগুলো গ্রহণ করে বিশ্বের অনেক স্থানেই কিন্তু প্রত্যাশিত ফল পাওয়া গেছে।
এছাড়া, ব্যাপকভাবে ছাদ বাগান করা, ভবন ও ফুটপাথে সাদা রঙ করার মাধ্যমেও তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে অনেকটাই।