জালিয়াতির মাধ্যমে স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী থেকে সাততলা বাড়ি ও ছয় ফ্ল্যাটের মালিক তিনি
এই জালিয়াত চক্রটি মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত, বহুদূর পর্যন্ত তাদের হাত প্রসারিত।
তারা চাইলে একই ব্যক্তির ভিন্ন নামে ১০টি জাতীয় পরিচয়পত্র বানাতে পারে, কিংবা একই ফ্ল্যাট বা জমির একাধিক জাল দলিল তৈরি করে অসংখ্য ক্রেতার কাছে বিক্রির নামে ঠকিয়ে নিতে পারে। আবার চাইলে একই সম্পত্তি বন্ধক রেখে অসংখ্য বার ব্যাংক থেকে ঋণও নিতে পারে।
এভাবেই তারা কয়েক বছর ধরে ফ্ল্যাট বিক্রির কথা বলে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
আজ শনিবার (৪ মে) বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এই চক্রের ১১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।
এদের মধ্যে রয়েছে চক্রের হোতা, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা এবং একজন এনআইডি কর্মচারী।
সিআইডি বলেছে, ভূমি অফিস, ব্যাংক, সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে শুরু করে এনআইডি অফিস পর্যন্ত প্রায় সর্বত্র এই চক্রের যোগাযোগ রয়েছে।
তারা জানান, জয়নাল আবেদীন এ ধরনের একটি চক্রের মূল হোতা। সম্প্রতি তার একাধিক প্রতিষ্ঠানসহ ২৫ জন সদস্যের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) প্রতিরোধ আইনে মামলা করে সিআইডি।
এরপর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে জয়নাল আবেদীন ইদ্রিস (৪০), তার প্রধান সহযোগী রাকিব হোসেন, ভায়রা কে এম মোস্তাফিজুর রহমান, জাল কাগজপত্র ও এনআইডি প্রস্তুতকারক লিটন মাহমুদ, ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল প্রস্তুতকারক হাবিবুর রহমান, ব্যাংক কর্মকর্তা হিরু মোল্যা, আবদুস সাত্তার ও সৈয়দ তারেক আলীকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এর আগে এ মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন পর্যন্ত এ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১ জনকে।
সিআইডি সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, 'জালিয়াতি করে একটি ফ্ল্যাটের বিপরীতে সাতটি ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয়েছে বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। এটা কীভাবে সম্ভব? এটা আমারও প্রশ্ন। '
তিনি বলেন, 'আপনি যদি কারো নামে ১০টি এনআইডি কার্ড চান, তারা তাও করে দিতে পারে। আবার এক জমি বা একটি ফ্ল্যাটের বিপরীতে ১০টি দলিল প্রয়োজন হলে, তারা তাও করে দিতে পারে।
মহম্মদ আলি মিয়া বলেন, 'সব জায়গায়ই তাদের চক্রের লোক আছে।'
সিআইডি প্রধান আরও বলেন, চক্রের প্রধান জয়নাল আবেদীনের বিভিন্ন নামের ছয়টি এনআইডি কার্ড ছিল।
ইদ্রিস বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি সাততলা ভবন এবং মিরপুর ও আশকোনা এলাকায় পাঁচটি ফ্ল্যাটসহ আরও আটটি ফ্ল্যাটসহ প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ভুয়া ঋণ নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। কাগজপত্র জাল করে ফ্ল্যাটগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রিও করতেন তিনি।
চক্রটি যেভাবে কাজ করত
প্রথমে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট দেখিয়ে ফাঁদ পাতা হতো। দেখানো জমির দলিলের কাগজপত্রগুলো সবই থাকতো হালনাগাদ এবং দেখতে খাঁটি।
ক্লায়েন্ট একবার টোপ গিললে, তার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেওয়া হতো। এছাড়া একই সম্পত্তির বিপরীতে একাধিক ঋণ নিতেও জাল কাগজপত্র ব্যবহার করা হতো।
সিআইডির তদন্তে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে পাচারের অভিযোগ পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইদ্রিস নিজে রাজধানীর মিরপুরে সমবায় মার্কেটের একটি স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
পরে শহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ইদ্রিস ফ্ল্যাট জালিয়াতি শুরু করেন। ইদ্রিসের দুই স্ত্রী রুম্মানা ও রাবেয়া আক্তার মুক্তাও ইদ্রিসের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন।
প্রতারণার জন্য ইদ্রিস মূলত ছয়টি জাল এনআইডি কার্ড ব্যবহার করতেন। এসব পরিচয়পত্র দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৫০টি অ্যাকাউন্ট খোলেন তিনি।
ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য খাত থেকে তিনি যে অর্থ উপার্জন করতেন, সেসব তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পেছনে ব্যয় হতো।