স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে মিডওয়াইফের সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে মাসে ২০-২৫টি নরমাল ডেলিভারি করা হয়। একেবারে জটিল পরিস্থিতি তৈরি নাহলে এখন সেখানে সিজারিয়ান ডেলিভারি তেমন হয় না; সিজারিয়ানের ঘটনা হয়তো মাসে ২-৪টি। হাসপাতালটিতে মাতৃমৃত্যুর ঘটনাও তেমন নেই। অথচ ৬ বছর আগেও এই হাসপাতালে মাসে ২-৩টি নরমাল ডেলিভারি হতো। এখানে নরমাল ডেলিভারির হার বাড়াতে কাজ করছে ৩ জন মিডওয়াইফ।
এই মিডওয়াফদের মধ্যে একজন নুসরাত জাহান। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত রক্তচাপ, ওজন ও ফিটাল মুভমেন্ট (গর্ভের সন্তানের নড়াচড়া) পরীক্ষা করি। গর্ভধারণের পর কী কী ধরনের টেস্ট করতে হয়, আমাদের কাছে তার চেকলিস্ট আছে। আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী মায়েরা সেসব টেস্ট করে গাইনি ডাক্তারদের দেখান।"
"মায়েদের লেবার পেইন উঠলে আমরা বাচ্চা-মা কেমন আছে, বারবার তদারকি করি। একটি ডেলিভারিতে সাধারণত ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে, তখন বিভিন্ন শিফটে আমরা তিনজন মিডওয়াইফ লেবার পেইন ওঠা মায়েদের তদারকি করি। নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না হলে, তখন আমরা রোগীকে সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য রেফার করি, তবে সে হার খুবই কম," বলেন নুসরাত।
নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য মিডওয়াইফারি সেবা অপরিহার্য। এই সেবা মাতৃমৃত্যুর হার কমানো ও নরমাল ডেলিভারির হার বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে দেশে প্রয়োজনের তুলনায় মিডওয়াইফের ঘাটতি এখনো প্রায় ৮৫ শতাংশ। দেশে মাতৃমৃত্যু কমাতে ও নরমাল ডেলিভারির হার বাড়াতে মিডওয়াইফারির সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, দেশে ২০,০০০ মিডওয়াইফের প্রয়োজন– যেখানে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মাত্র ৩,০০০ মিডওয়াইফ কাজ করছেন। মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে এবং নরমাল ডেলিভারির হার বাড়াতে এই সংখ্যা বাড়াতে হবে বলে মত তাদের।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক তহবিলের তথ্য অনুযাযয়ী, গত এক দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ৮,৬৪৬ জন মিডওয়াইফ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন। এরমধ্যে ২,৫৫৭ জনকে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, বর্তমানে ৩৭৬ জন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত আছেন।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও প্রায় ৪০০ জন মিডওয়াইফকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দেশের ৪০৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮৬ শতাংশ সন্তান প্রসবে সাহায্য করছেন মিডওয়াইফরা।
দীর্ঘদিন ধরে সি-সেকশন ডেলিভারির বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত জনস্বাস্থ্যবিদ ড. ইশতিয়াক মান্নান।
ড. ইশতিয়াক মান্নান বলেন, "২০১৯ সালে সিজারিয়ান ডেলিভারি কমাতে সরকার যে গাইডলাইন তৈরি করেছে সেখানে মিডওয়াইফ তৈরির কথা থাকলেও বাস্তবে মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়ার হার কম। জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য খাতে ২০ হাজারের বেশি মিডওয়াইফ মোতায়েন করতে হবে।"
এদিকে, নরমাল ডেলিভারির হার বাড়ানো ও মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে প্রয়োজন অনুযায়ী আরও ৫ হাজার মিডওয়াইফের পদ তৈরিতে গত বছর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেই জনবল নিয়োগ দিতে রাজি হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় মাত্র ৪৫০ জন মিডওয়াইফের পদ সৃষ্টি করে।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. নাসির উদ্দিন (উপসচিব) টিবিএসকে বলেন, "৪৫০ জন মিডওয়াইফের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শুধু প্রান্তিক পর্যায়ে নয়, বড় বড় হাসপাতালেও এবার মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া হবে। মিডওয়াফের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আমরা আবারো চিঠি লিখেছি। আশা করছি, আরও মিডওয়াইফের পদ তৈরি হবে।"
হাজারও জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখছে মিডওয়াইফ
বাংলাদেশে অনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৮ সাল থেকে মিডওয়াইফরা কর্মশক্তিতে প্রবেশ শুরু করে। তবে, জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যে তারা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে হাজারও মা ও নবজাতকের প্রাণ বাঁচাতে ভূমিকা রেখেন। গবেষণা বলছে, নীতিনির্ধারকরা যদি মিডওয়াইফারিতে গুরুত্ব দেন, তবে তারা আরও বেশি জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারেন।
'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩' এর তথ্য মতে, ২০২৩ সালে দেশে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ছিল ৫০.৭ শতাংশ।
যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, একটি দেশে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সিজারিয়ান ডেলিভারি থাকা উচিত। এর বেশি হলেই তা উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশের অবস্টেট্রিকাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির সাবেক সভাপতি ও প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, "মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য মিডওয়াইফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমাতে ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারি বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রসবের সময় মিডওয়াইফের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।"
"নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে একজন রোগীর পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা সম্ভব হয়না বিশেষজ্ঞ গাইনি চিকিৎসকদের। সেক্ষেত্রে মিডওয়াইফরাই তাদের পর্যবেক্ষণ করেন, কোনো সমস্যা হলে তখন চিকিৎসক দেখেন। সারাবিশ্বে নরমাল ডেলিভারি করেন মিডওয়াইফরা।"
"আমাদের দেশে অনেক মিডওয়াইফ তৈরি হয়েছে, কিন্তু এখনো তাদের ঠিকমত পদায়ন করা হচ্ছেনা, পাশ করার পর বেকার রয়েছেন অনেক মিডওয়াইফ। মাতৃস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় মিডওয়াইফদের দ্রুত পদায়ন করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ (৫ মে) পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফ দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো— 'মিডওয়াইভস: আ ভাইটাল ক্লাইমেট সল্যুশন', যার বাংলা ভাবার্থ দাঁড়ায়– 'মিডওয়াইফস: জলবায়ু সংকটে অপরিহার্য জনশক্তি'।
দিবসটি উপলক্ষে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ মিডওয়াইফারি সোসাইটি বলেছে, "আমরা সরকারকে অবিলম্বে আরও মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়ার পাশপাশি একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি ও তাদের পূর্ণ পরিসরে অনুশীলনের সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করছি।"
"এর মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে এবং এটি সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের একটি পথ হিসেবে কাজ করবে। মিডওয়াইফারিতে বিনিয়োগ করে আমরা জীবন বাঁচাতে পারি এবং প্রত্যেক মা ও নবজাতককের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন যত্নসেবা নিশ্চিত করতে পারি," বলা হয় বিবৃতিতে।